মনের ঘরে যেদিন ইঁদুর ঢুকলো

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে বের হবার দিন কয়েকের মধ্যেই আমি আবিষ্কার করলাম, আমার মনের ঘরটা একেবারেই ফাঁকা – দিন-রাত অদ্ভুত এক শূন্যতা হাহাকার করে ওখানে। শুধু মাঝে-মধ্যে একটা ন্যাংটা ইঁদুর ঘরটার এক পাশ থেকে অন্য পাশে দৌড়ে চলে যায়। ভীষণ অস্বস্তি তৈরী করার জন্যই বোধহয় সে ওটা করে।

হ্যা, কয়েকদিন হলো আমার মনের সেই ফ্ল্যাটে একটা ইঁদুর ঢুকেছে। এটা কি আমার দ্বিধা? আমার সন্দেহ?

হতে পারে, এটা নিছক একটা সন্দেহ। অনেক কিছু নিয়েই আমার সন্দেহ আছে – আইডিয়াল হাই স্কুলে যা পড়িয়েছে তা নিয়ে সন্দেহ, কাটাবন মসজিদে যে ধর্মচর্চার কথা বলে তার ভেতর ঈশ্বর-বিশ্বাসের অংশ নিয়ে সন্দেহ, ফার্স্ট ইয়ারে পড়ার সময় যে দলের হয়ে রাস্তায় মিছিলে নেমেছিলাম তাদের উদ্দেশ্য আর দেশপ্রেম নিয়ে সন্দেহ, বাবা-মা আমাকে ভালোবাসে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ, এরকম আরো কত সন্দেহ আর দ্বিধা! সত্যি কথা বলতে কি, মাঝে মাঝে আমার নিজের অস্তিত্ব নিয়েও সন্দেহ হয় – “আমি” বলতে আদৌ কি কেউ আছে? দেকার্তে অবশ্য বলেছিলেন – আমি যে চিন্তা করছি, এটাই তো প্রমাণ যে আমি আছি।

সন্দেহ হোক আর যাই হোক, নিজের চোখে যখন একটা কিছুকে দৌড়ে যেতে দেখেছি, ইঁদুর ছাড়া সেটাকে আর কিছু ভাবা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। অতিবিশ্বাসী ধর্মানুরাগীদের কেউ হলে হয়তো সেটাকে ছদ্ববেশী জ্বীন, অকল্যাণমূলক শয়তান, কিংবা এমনকি হয়তো রহমতের ফেরেশতা ভাবতো, কিন্তু আমি প্রমান ছাড়া কিছুতে বিশ্বাস করিনা। আর আমি খুব ভালো করেই জানতাম, ছোট্ট ওই প্রাণীটার সাথে ছুঁচো কিংবা ইঁদুরের বাচ্চার সাদৃশ্য ছিল প্রবল। এখন আমার কর্মপদ্ধতি হবে এই জিনিসটাকে ফাঁদ দিয়ে মেরে ফেলার মাধ্যমে নিজেকে এর হাত থেকে বাঁচানো, কিংবা একে চোখের আড়াল করার মাধ্যমে একে আমার হাত থেকে বাঁচানো। যেহেতু আমি প্রাণীহত্যার প্রবল বিরোধী, বিশ্বাস করি যে প্রাকৃতিকভাবে বিলীন হওয়ার আগ পর্যন্ত সব প্রানীরই বাঁচার অধিকার আছে, সেহেতু দ্বিতীয় পথটাই বেছে নিলাম। আমার মনে হলো, ঘরটা শূন্য বলেই এই ভদলোককে বার বার দেখা যাচ্ছে, ঘরে জিনিস-পত্রের প্রাচুর্য থাকলে নিশ্চয়ই উনি আড়াল হয়ে যেতেন।

বৈশাখের এক তপ্ত নির্জন দুপুরে কার্জন হলের সামনে দিয়ে হেটে যেতে যেতে স্পষ্টভাবে আমার সেটাই মনে হলো।

সেদিন থেকে মনের সেই ঘরটা পূরণ করতে শুরু করলাম আসবাব-পত্র দিয়ে। আমি নিশ্চিত ছিলাম, আসবাবপত্র দিয়ে ঘর ভরে ফেললে আর দেখতে পাবো না ইঁদুরটাকে। সীমিত সামর্থ্যের মধ্যে যা যা পারলাম সবই আনলাম আমার মনের ঘরে – একটা সিঙ্গেল খাট, ল্যাম্পসহ একটা পড়ার টেবিল, বই বোঝাই একটা লাইব্রেরি, আশির দশকের গান শোনার জন্য কিছু ক্যাসেট, আর একটা ফুলের টব।

আসবাবগুলো ঘরে নেয়া একটা চ্যালেঞ্জ ছিল, কেননা আমার মনের ঘরে লিফ্ট ছাড়া যাওয়া সম্ভব না। আর সম্ভব হবেই বা কি করে, এই ঘরটা তো গোপন একটা স্থান-কালে। স্বয়ং আইনস্টাইনও তার আপেক্ষিকতার তত্ত্ব দিয়ে আবিষ্কার করতে পারতেন না এই ঘরের অস্তিত্ব, প্রমান করা তো দুরস্ত, কারণ মনের এই ঘরটা নাখালপাড়ার আমাদের এই ভাড়াবাসার দোতলা আর তিনতলার ঠিক মাঝখানে। সিঁড়ি বেয়ে উঠলে দোতলার যেখানে ছাদ, তিনতলার মেঝে সেখানে শুরু, সুতরাং সিঁড়ি দিয়ে ওই ঘর পর্যন্ত পৌঁছানো কিংবা ওই ঘরে ফার্নিচার নেয়া প্রায় অসম্ভব। কিন্তু লিফটের কথা আলাদা।

যা ভেবেছিলাম, তাই হলো। আসবাবগুলো দিয়ে ঘর বোঝাই করার পর জনাব ইঁদুরের আনাগোনা একেবারেই কমে গেলো। আমি জানি, সেটা আমার ঘরেই আছে কোথাও, যাবে আর কোথায়! হয়তো সে আমার দিকে বার বার তাকাচ্ছে খাটের নিচ থেকে। হতে পারে, সে বইয়ের তাকে বসে বসে দাঁত দিয়ে খুঁচিয়ে বইগুলোর স্মৃতি থেকে তুলে ফেলছে সব অক্ষর। হতেও পারে। তবে সে যে ঘরের বাইরে যায় নি, এটা আমি নিশ্চিত। আর পালাবেই বা কি করে, একবার এখানে ঢোকার পর সে তো বন্দি হয়ে গেছে আমার মনের এই ঘরে, সিঁড়ির অবস্থান খুঁজে পাচ্ছে না বলে না পারছে দোতলায় গিয়ে পলাতক হতে, না পারছে সীমান্ত অতিক্রম করে অবৈধভাবে অনুপ্রবেশ করতে তিনতলায় বাড়িওয়ালার মোটা-তাজা রান্নাঘরে।

তবে ইঁদুরের অত্যাচার থেকে আপাতত মুক্ত হওয়ার কারণে আমি আবার ভালোবাসতে শুরু করতে পারলাম আমার মনের ঘরটাকে। আমি ভালোবাসলাম এর সামনের ছোট্ট ব্যালকনি আর টবের ভেতরকার গোলাপ গাছদুটোকে। ভালোবাসতে চেষ্টা করলাম জানলার পাশের সিঙ্গেল খাটটাকে, যেটাতে শুয়ে আমি দেখতে পেতাম এক চিলতে আকাশ আর এভাবে প্রতিদিন প্রতিরাতে অসীম আকাশটাও আমার সসীম ঘরের অংশ হয়ে যেত। আর এভাবে বসার চেয়ার, লেখার টেবিল, পুরোনো বইয়ে ঠাসা বুকশেলফ, হলুদ ল্যাম্পও আমার মনের ঘরের অংশ হয়ে গেলো। আড়াইতলা? হ্যা, এটাকে তুমি আড়াইতলা বলতে পারো, যেহেতু দোতলা আর তিনতলার মাঝখানে এটা, একে আড়াইতলা বলা ভাষাগত দিক দিয়ে সঠিক আর নির্ভুল।

এভাবে মনের ঘরে ফার্নিচার ভর্তি করে আমি সুখীই ছিলাম। কিন্তু মাস তিনেক যেতে না যেতেই আবার শুরু হলো সমস্যা, মানে আবার সে ঘরে ভীষণ অস্বস্তি হয়ে মাঝে-মধ্যেই উঁকি দিতে শুরু করলো সেই ছোট অস্থির ইঁদুরটা। হ্যা, আমি তাকে পাত্তা দিচ্ছিনা বলেই হয়তো আমার মনোযোগ আকর্ষণের জন্য সে পড়ার টেবিলের ওপর উঁকিঝুঁকি দেয়া শুরু করলো, এমনকি মাঝে-মধ্যে বিছানার ওপর দিয়েও দৌড়াদৌড়ি করতে দেখা গেলো বদমাশটাকে।

কিন্তু এরপরই তোমার সাথে দেখা হয়ে গেলো আমার। আমাদের ছোট্ট গবেষণা প্রজেক্টের ডাইনিং রুমে তুমি যখন আমার সাথে দুপুরের খাবার খেতে খেতে অনেক গল্প করতে, আমার দিনটাই সুন্দর হয়ে যেত। মেসে ফিরে এসেও ভাবতে থাকতাম তোমারি কথা।

আসমা, তোমার মনে আছে, প্রথম যেদিন তুমি আমার মনের ঘরে বেড়াতে এলে? তুমি সিঁড়ি দিয়ে উঠতে চাচ্ছিলে, তখন আমি তোমাকে বললাম – “আমার বাসায় লিফ্ট ছাড়া যাওয়া যায় না।”

“কেন? তোমার ঘর কয় তলায়?” – তুমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলে।

“আমার প্রিয়তমেষু, তুমি যদি লিফ্ট ব্যবহার করো, আর তুমি যদি আমার মতো অত্যন্ত সৌভাগ্যবান একজন হও, তাহলে তুমি পেলেও পেয়ে যেতে পারো আমার এই ভীষণ গোপন ঘরে যাওয়ার ব্যতিক্রমী রাস্তাটা। শুধু মনে রেখো, যেদিন খুলবে তোমার সেই কপাল, তুমি টিপবে ওপর তলায় যাওয়ার সুইচ, কিন্তু একসাথে জ্বলে উঠবে দোতলা আর তিনতলার লাইট পুরোনো এই লিফটটার ভেতরে। দোতলা আর তিনতলার মাঝখানে এসে একটা ঝাঁকি দিয়ে থেমে যাবে যন্ত্রটা, তারপর এর ভেতরটা অন্ধকার হয়ে যাবে। যেন আলো নামে কোন কিছুর সৃষ্টিই হয়নি কোনোদিন এতটা অন্ধকার। তুমি যখন ভাবছো তুমি মারা গেছো আর এটা বরযখের পৃথিবীর একটা অংশ, ঠিক তখনই লিফটের দরজাটা ঝা করে খুলে যাবে আর তোমার পরিচিত জগতের ওপাশে তুমি দেখবে ধোঁয়াশা আর ঘোলাটে আলো। ওই সময় একটু সাহস করে কিছুটা এগিয়ে গেলে তুমি দেখতে পাবে একটা মাত্র দরজা। লম্বা একটা করিডোরের ঠিক মাঝখানে একটা মাত্র কালো দরজা। ওটাই হলো আমার মনের ঘর। সেই দরজায় কোনোদিন তালা দেয়া থাকে না। যারা লিফ্ট পার হয়ে ওই কালো দরজা পর্যন্ত যেতে পেরেছে, তাদের জন্য সেই ঘর চির উন্মুক্ত।”

তুমি হাসলে। আসমা, তুমি ভাবলে, আমি তোমার সাথে তামাশা করছি। কিন্তু সেদিন সে বিকেলে তুমি সত্যি সত্যিই আমার মনের ঘর পর্যন্ত আসতে পেরেছিলে, যদিও অল্প কিছু সময় থেকেই কোন পিছুটানে ফিরে গিয়েছিলে তোমার বাসায়, আর তাড়াহুড়োর  কারণে ভুল করে ফেলে গিয়েছিলে তোমার ছায়া আমার এই মনের ঘরে।

স্বাভাবিকভাবেই এর পর থেকে আমার মনের ঘরে আবাস গড়ে নিলে তুমি, তোমার ছায়া ব্যবহার করে। একসময় সে ঘরে সারাদিন ঘুরে-ফিরে বেড়াতে লাগলো সেই অলৌকিক ছায়া – কখনো হালকা সবুজ শাড়িটা পরে, মাঝে মাঝে শাড়ি ছাড়া। আর তোমাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকার কারণে সেই কয়টা দিন ইঁদুরটা একরকম অদৃশ্যই হয়ে থাকলো আমার ঘরে। আরো কয়েকদিনের জন্য তীব্র স্বস্তি পেলাম আমি।

কিন্তু এই পৃথিবীতে কোনোকিছুই স্থায়ী নয়, কোন ভালোবাসায় অমোঘ নয়, ফলে তোমার সেই ছায়াও একদিন আমার মনের ঘর থেকে পালিয়ে গেলো দূরে কোথাও। তুমি তোমার বিয়ের কার্ড হাতে নিয়ে হাসি হাসি মুখে খবরটা বললে যেদিন, সেদিন মনের ঘর থেকে তোমার স্মৃতিচিহ্নটাকে আমার বিদায় জানাতেই হলো। তখন, সেসময়, আবার, আরেকবার, আমার মনের ঘরে উপদ্রব শুরু করলো নচ্ছার সেই ইঁদুরটা। এটা কি শুধুই আমার দ্বিধা? শুধুই সন্দেহ?  হতে পারে।

কিন্তু এইবার আমি ছিলাম সাবধান। নিজের ঘরে রেখে দিলাম বিশাল এক আয়না, যেন নিজের ছবি ছাড়া আর কিছুই আমাকে দেখতে না হয়, ফলে আড়ালে থাকে মূর্তিমান আতঙ্ক সেই ইঁদুরটাও। কিন্তু এক মেঘলা সন্ধ্যায় অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, আয়নার ওপাশের মানুষটা আমি নই। প্রথম কয়েকদিন আয়নায় দেখলাম আমার জায়গায় আমার মৃত বাবার ছবি, কয়েকদিন মা-কেও যেন দেখলাম, এমনকি একদিন নিজের প্রতিচ্ছবির জায়গায় দেখতে পেলাম কবি নির্মলেন্দু গুনকে। আতংকিত হয়ে আয়না পুরোপুরি ঢেকে দিলাম বিছানার চাদর দিয়ে। বুঝতে পারলাম না, আয়নায় কেন আমি নিজের ছবি দেখতে পাচ্ছি না।

সেই থেকে মনের ঘরে ঢোকা একেবারেই বন্ধ করে দিলাম আমি। সারাদিন ঘোরা-ফেরা করি প্রাচীন ঢাকা শহরের পথে-প্রান্তরে, সারারাত ধোঁয়া-ওঠা ওষুধের নেশায় ডুবে থাকি চোখ গর্তে ডুবে যাওয়া সায়রা মেয়েটার সাথে। মনের ঘরের ইঁদুরটাকে একেবারেই পাত্তা দেই না, দিনের পর দিন হতাশ করতে থাকি তাকে। ততদিনে আমি বুঝে ফেলেছি, ইঁদুরকে শায়েস্তা করার সত্যিকার উপায় হচ্ছে তাকে পুরোপুরি উপেক্ষা করা। 

কিন্তু ইঁদুরের দৌড়াদৌড়িতে নিজেকে অভ্যস্ত করতে পারলেও সহ্য করতে পারছিলাম না উদ্দেশ্যহীন জীবন কাটানো। এক ভোর রাতে মনের ঘরের আয়নায় আলো দেখে মনে হলো, আশা একেবারে শেষ হয়ে যায় নি। অনুভব করলাম, ইঁদুর আর আমি ছাড়াও মনের ঘরে আছে অন্য কেউ। অন্য কেউ, যে কথা বলে, নির্দেশনা দেয়, স্বান্তনা হয়, কিন্তু দেখা দেয় না কোনোদিন। কবির ভাষায় – “কে কথা কয় রে, দেখা দেয় না, নড়ে-চড়ে হাতের কাছে, খুঁজলে জনমভর মেলে না।“

সেই ভোররাতে ভেবে ভেবে অস্থির হয়ে গেলাম, কে হতে পারে আমার দৃষ্টিশক্তির বাইরের সেই স্বত্বা। সেই শেষরাতে আমার চিন্তার ওই অস্থিরতা আমাকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখলো, ফজরের আজান কানে যাবার আগ পর্যন্ত। সে রাতে কেমন করে যেন রাত ভোর হওয়ার আগেই নিশ্চিত হয়ে গেলাম, এই পৃথিবীতে আমি একা নই – এমনকি আমার শূন্য ঘরের ভেতরও আমি নিঃসঙ্গ নই।

আর একবার যখন নিশ্চিত হলাম যে আমি একা নই, নিঃসঙ্গ নই এই পৃথিবীতে, সাথে সাথে ইঁদুরের উপদ্রব কমে গেলো আমার ঘরে। এমনকি একসময় আমার মনে হলো, ইঁদুর বলে কিছু ছিলই না আসলে আমার ঘরে – পুরোটাই ছিল আমার দ্বিধা কিংবা সন্দেহ, দেখা বা বোঝার ভুল।

সেই দিনের পর থেকে, সেই ভোর রাতের পর থেকে. কোন এক অজানা কারণে, আজ পর্যন্ত ইঁদুরটাকে আমার মনের ঘরে আর দেখিনি। যেমন শূন্য থেকে হঠাৎ উদয় হয়েছিল, ঠিক তেমনি আবার রহস্যজনকভাবে শূন্যে উধাও হয়ে গিয়েছিলো সেটা চিরতরে আমার জীবন থেকে।

রক্তিম লাল মলাটের ডাইরিটা সশব্দে বন্ধ করে ডেডবডিটার দিকে তাকালো নাজমুল হোসেন। এই ছেলেটা ওদের বিল্ডিঙের চিলেকোঠায় থাকতো। অন্য বাড়িওয়ালাদের মতোই হিসেবি আফসার সাহেব, ছাদে রুম বানিয়ে ব্যাচেলর ভাড়া দিয়েছেন। এখন সে বেওয়ারিশ লাশ। বুঝুক মজা।

আফসার সাহেবের স্ত্রী করিৎকর্মা। নাজমুলকে দেখে বললেন – “বুঝলেন, ছেলেটা একটু অদ্ভুত ছিল।”

তার অবশ্য জানার কথা, তিনিই তো মাসের প্রথম দিন সব ফ্ল্যাটে গিয়ে গিয়ে ভাড়া আদায় করেন।

“একটু না, বেশিরকম অদ্ভুতই ছিল। একা একা থাকতো, কারো সাথে মিশতো না, গেটে কারো সাথে দেখা হলেও কথা বলতো না। সন্ধ্যায় অফিস থেকে যে ফিরতো, এরপর কোথাও বেরুতে দেখতাম না। দিন-রাত ঘরে বসে থেকে কি করতো খোদাই জানে।”

নাজমুলও দেখেছেন দু-একবার ছেলেটাকে। পাশে হেটে যাওয়ার সময় দৃষ্টি ফ্লোরের দিকে রাখতো সে, নাজমুল বুঝতেন এটা ছিল দৃষ্টি এড়ানোর জন্য তার পুরোনো বহু ব্যবহৃত কৌশল। ছেলেটা আসলে তার ঘরের ভেতরই লুকিয়ে থাকত, একরকম পালিয়ে থাকতো নিজের মধ্যে।

“গতকাল রাত্রে মারা গেছে। মনে হয়, হার্ট এটাক। এছাড়া আর কি হবে ! দেখেন, কিরকম ভাগ্য ! এইরকম একটা বয়সে কিনা একা একা মারা গেলো ! আমার কেন যেন মনে হয়, ঘুমের মধ্যে মরেছে। ঘুমিয়েছে, আর উঠতে পারে নি।”

ভদ্রমহিলা বললেন, ভাগ্যিস ওর দূর সম্পর্কের কোন ভাইয়ের নাম্বার ছিল উনার কাছে। তাকেই খবরটা দিয়েছেন আজ সকালে। সেই ভাই আসছে লাশের ব্যবস্থা করতে।

নাজমুলের অফিসের তাড়া ছিল। তাই কথা না বাড়িয়ে দ্রুত লিফটের দিকে পা বাড়ালেন তিনি। তখন তার মনে পড়লো, আফসার সাহেবের স্ত্রীকে ছেলেটার নাম জিজ্ঞেস করা হয় নি। আর কোনোদিনই হয়তো ওর নাম জানা হবে না তার। আফসোস !  

লিফটের দরজা বন্ধ হতেই মনের অজান্তেই দুই আর তিন নাম্বার সুইচ টিপে দিলেন তিনি একসাথে। বুকটা ধ্বক করে উঠলো তার, যখন দেখতে পেলেন দু’টা লাইট একসাথে জ্বলে উঠেছে।

পুরোনো লিফটের ভেতর একা দাঁড়িয়ে থেকে নাজমুল দর দর করে ঘামতে শুরু করলেন। লিফ্ট ততক্ষনে ঢিমে তালে নিচে নামতে শুরু করেছে।

One thought on “মনের ঘরে যেদিন ইঁদুর ঢুকলো

Leave a reply to Haursho Lipikaar Cancel reply