আজ সকাল থেকে আমি আমার ছায়াটা খুঁজে পাচ্ছি না।
সময় সময় জিনিস-পত্র হারিয়ে ফেলার বদভ্যাস আছে আমার। সবচেয়ে বেশি হারায় কলম। এরপরই আছে মৌজা। পাঁচ জোড়া মৌজার কোনোটাই কোনোটার সাথে মিলছে না, এমন ঘটনাও আছে আমার জীবনে। মাঝে মাঝে চশমাও হারাই আমি, আর চশমা ছাড়া খালি চোখে চশমা খোঁজা কি ধরণের বিড়ম্বনা, তা হাই-মাইনাস পাওয়ারের যে কোন অন্ধত্ব-রোগী জানে। বিচিত্র এই পৃথিবী। কিন্তু ছায়া হারিয়ে ফেলা এই প্রথম।
সকালে অফিসে যাওয়ার সময় প্রথম বিষয়টা লক্ষ্য করি আমি। সাড়ে আটটায় তাড়াহুড়া করে রিক্সায় উঠতে যাবো, হঠাৎ মনে হলো কি যেন একটা কিছু মিলছে না। এদিক তাকালাম, ওদিক তাকালাম, আকাশের দিকে তাকালাম, রাস্তার দিকে মাথা নিচু করে দেখলাম। তখনি হঠাৎ দেখলাম, ফুটপাতের ওপর রিক্সার ছায়া পড়ছে কিন্তু পাশে – যেখানে সূর্যের আলোর গতিপথ আটকে দিচ্ছে আমার বস্তুবাদী করোটি, সেখানে – আমার ছায়া নেই।
প্রথমে ভাবলাম, হয়তো আমার ছায়া বড় কোন কিছুর আড়ালে পড়েছে। কিন্তু ব্যাখ্যাটা পুরোপুরি মেনেও নিতে পারলাম না, কেননা ঐতো পাশে রিক্সাওয়ালার ছায়া দিব্যি দেখা যাচ্ছে।
গলি থেকে বের হয়ে রিক্সা মিন্টু রোডে ওঠামাত্র সকালের আলো-ছায়াতে দেখলাম রাস্তার লোকজনের মধ্যে কেমন যেন একটা চাঞ্চল্য। রিক্সাওয়ালা বললো, আজকে মিটিং-মিছিল হবে, এবং “ঘটনা ঘটবে”। আমি জানতে চাইলাম, কি ঘটনা ঘটবে। সে বললো, “ছাত্র-জনতা আজকে ঢাকা ঘেরাও দিবে।“
আমি হেসে উঠলাম – “ও, এই ঘটনা? এসবে কোন লাভ হবে না। খামোখা দৌড়াদৌড়ি আর মানুষের ভোগান্তি।”
“মানুষ ভোটের অধিকার ফেরত পাবে, স্যার।”
“ভোটাভুটি অর্থহীন। গণতন্ত্র হলো মূর্খের শাসন। আসলে কিছুতেই কিছু যায় আসে না।”
অফিসে পৌঁছেই লিফটে চড়ে উঠলাম তিনতলায়, তারপর ডেস্কে না গিয়ে সোজা চলে গেলাম বাথরুমে। সফদর সাহেব বাথরুম থেকে বের হচ্ছিলেন, তাড়াহুড়া করতে গিয়ে তার সাথে টক্কর লাগতে যাচ্ছিলো প্রায়। লোকটা কি চোখে দেখে না নাকি। তবে এই ভদ্রলোককে দেখে আমি নিশ্চিত হলাম, এটা মোটেই স্বপ্নের কোন দৃশ্য না।
আরো নিশ্চিত হলাম, যখন আফতাব চৌধুরী জিওটেক্সটাইলের ফাইলটা আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন, একবারের জন্য আমার দিকে না তাকালেন না – বরাবরের মতো। আমি জানি, এই অফিসের বেশির ভাগ লোক আমাকে দেখে কাজের একটা হাতিয়ার হিসেবে। আমি নিশ্চিত, এদের অনেকে আমার নামও জানে না। এ নিয়ে অবশ্য আমার কোন অভিযোগ নেই, আমিও তো কত লোকের নাম জানি না।
বাথরুমে ঢুকে আয়নায় চোখ রাখতেই বুঝতে পারলাম, আমার আশংকা সত্য – খোয়া গেছে আমার ছায়া। আয়নায় আমি কাউকে দেখতে পাচ্ছি না, শুধু আমার স্ট্রাইপ করা লাল শার্ট দেখা যাচ্ছে কলার পর্যন্ত – যেন এই শার্টের অধিবাসী হারিয়ে গেছে, যেন এই শূন্যস্থানে থাকতে পারতো অন্য যে কেউ। অন্য যে কেউ আমার জীবনে থেকে আমার কাজগুলো করে দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে পারতো, অন্য যে কেউ।
তবে সত্যি কথা বলতে গেলে, আমি খুব একটা বিচলিত হলাম না। ছায়া যে মানুষের খুব একটা কাজে লাগে, এমন না। তাছাড়া আমার ছায়া না থাকাটা কোন মানুষ খেয়াল করবে, এমন সম্ভাবনা খুব কম। কেউ তার সহকর্মীকে এত মন দিয়ে দেখে বলে মনে হয় না, বিশেষ করে অকর্মন্য মনগুলা যখন পড়ে থাকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আর কর্মী মনগুলো পড়ে থাকে শেয়ারবাজারের দরপতনের দিকে। তবে চুল আচড়াবো কিভাবে, দাড়ি সেভ করবো কিভাবে, এসব ভেবে কিছুটা চিন্তিত না হয়েও পারলাম না। মনে হচ্ছে, সেলুনই হবে আগামী কয়েকদিনে আমার শেষ ভরসা – লেন্ডার অফ দ্য লাস্ট রিসোর্ট।
আমি খুব একটা বিচলিত হই নি, কিন্তু লাঞ্চের সময় হওয়ার আগেই শরীরটা খুব দুর্বল লাগতে শুরু করলো। রশিদের বইয়ের পাতাগুলোকে মনে হতে লাগলো পিতলের মতো ভারী, সাইনপেনটা মনে হলো ডাম্বেল একটা – উঠাতেই পারবো না আজকে। সময় যেন হঠাৎ করেই ভীষণ ধীরগতির হয়ে গেলো – দেয়ালের হলুদ ঘড়িটাতে সেকেন্ডের কাটাটা এক ঘর থেকে আরেক ঘরে যেতে আধা মিনিটেরও বেশি করে সময় নিতে লাগলো। মনের এককোনে ক্ষীণ একটা সন্দেহ উঁকি দিয়ে গেলো, হয়তো ছায়া না থাকার সাথে এর কোন সম্পর্ক থাকতে পারে।
গত জুলাই মাসে যখন কোভিড ভাইরাস ধরলো, তখন আমার এরকম হয়েছিল। প্রথম মনে হলো, এটা কোন ব্যাপার না, কিন্তু বারো ঘন্টার মধ্যে মনে হলো আমি কাফনের সাদা কাপড়ের ভেতর আটকে পড়া আতর-লোবানের ঘ্রাণযুক্ত এক লাশ, হাত-পা বাধা শরীরের ভেতর আটকে পড়া এক অস্থির আত্মা।
অসম্ভব না, এটাও সেরকমই নতুন কোন ভাইরাস, চীন বা উত্তর কোরিয়ার পরীক্ষাগারে যার উদ্ভব, তারপর অসাবধানতাবশত সেটা ছড়িয়ে পড়েছে বাইরে। হয়তো এর কাজ সৈনিকদের অদৃশ্য করে দিয়ে তাদেরকে পুরো মধ্যপ্রাচ্য দখলে সাহায্য করা, যেন দুই হাজার বছর পর যীশুর প্রত্যাবর্তন হতে পারে এই মর্ত্যে।
চোখে-মুখে পানি দেয়ার জন্য বাথরুমে গেলাম, যদিও জানতাম আয়নাতে চোখ-মুখ খুঁজে পাওয়া একটা ঝামেলার বিষয় হবে, ফলে পুরো কাজটাই করতে হবে আন্দাজের ওপর। কিন্তু বাথরুমে আমার জন্য অপেক্ষা করছিলো আরো বড়ো বিস্ময়। আয়নার সামনে গিয়ে দেখি, আমার জামা-কাপড়ও দেখা যাচ্ছে না। অথচ আজ সকালেও আয়নায় দেখতে পাচ্ছিলাম আমার লাল শার্ট আর নীল জিনসের প্যান্ট। ধারণা করলাম, এই ছায়াহীনতা কিছুটা সংক্রামকও বটে।
লাঞ্চের সময় আফতাব স্যারকে গিয়ে শরীর খারাপের কথা জানিয়ে বললাম, বাসায় যেতে চাই। আফতাব চৌধুরী মৌলভী মানুষ। মেহেদী লাগানো চার আঙ্গুল পরিমান দাড়ি তার, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামাতের সাথে পড়েন। কর্মচারীরা কোন কথা বললে উত্তর না দিয়ে তাকিয়ে থাকেন, যেন সে দ্বন্দ্বে পড়ে যায়। কাটাবন মাজারের পীরের ভক্ত তিনি। কথিত আছে, এক তাহাজ্জুদের সময় তিনি খিজির আলাইহিসসালামের দেখা পেয়েছিলেন।
স্যার মোটা চশমার আড়াল থেকে কিছুক্ষন আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন, তারপর থেমে থেমে বললেন – “কি? মিছিলে যাবেন নাকি?”
“জি না, মিছিলে যাই না, স্যার।”
“কেন যান না?”
“এসবে যেতে ভয় লাগে, স্যার।”
“কিসের ভয়?”
“যদি মরে যাই, যদি পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়ে হেনস্থা করে, এইসব, স্যার। আমি যদি মরেই যাই, তাহলে দেশে স্বৈরশাসন থাকলেই কি আর দেশ স্বাধীন হলেই বা কি!”
আফতাব সাহেব মমতার হাসি হাসলেন – “এই তো ঠিক ধরেছেন, আনিস সাহেব। মানুষের জীবন একটাই, আর এগুলি খামাখা সময় আর শক্তি নষ্ট। শোনেন আনিস সাহেব, ডেস্কে যান, কাজে মন দেন, দেখবেন সব অসুস্থতা ঠিক হয়ে গেছে।“
আমি টলতে টলতে নিজের টেবিলে ফিরে এলাম।
খেতে ইচ্ছে করছিলো না, তবু লাঞ্চের সময় জোর করে শুকনা রুটি আর ডাল মুখের মধ্যে গুঁজতে চেষ্টা করলাম। আশা করছিলাম, খাদ্যবস্তু শরীরকে শক্তি দেবে। ফিন্যান্সের রকিব ভাই বেঞ্চের উল্টোদিকে বসে চা খাচ্ছিলেন আর আমাকে লক্ষ্য করছিলেন। তিনি জানতে চাইলেন – আমার কি হয়েছে, আমি এরকম করছি কেন। আমি বললাম, সকাল থেকে আমার ছায়া খুঁজে পাচ্ছিনা, শরীরটাও দুর্বল লাগছে।
“এই সোমবার শেষ হওয়ার আগেই আমি পরিণত হবো একটা সবজিতে – যার প্রাণ আছে, কিন্তু চলার শক্তি নেই। রকিব ভাই, মনে হচ্ছে ধীরে ধীরে আমার অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাচ্ছে।”
কিন্তু তাকে খুব একটা বিচলিত হতে দেখলাম না। নাক খুঁটতে খুঁটতে বললেন – “অস্তিত্ব থাকলেই না সেটা বিলীন হবে?” – সে নির্জীব কণ্ঠে বললো – “এই যে আমরা খামোখাই শুধু ‘আমি’, ‘আমি’ বলি, ‘ফার্স্ট পার্সন এক্সপেরিয়েন্স’-এর কথা বলি, বিজ্ঞান প্রমান করেছে যে এগুলি সবই ডিলুশন।”
“আমার কোন অস্তিত্ব নেই? আমিত্বের ধারণা ডিলুশন?”
“অবশ্যই ডিলুশন। মানে দৃষ্টির ভ্রম। আচ্ছা তুমি কি তোমার দুই বছর বয়সের স্মৃতি মনে করতে পারো? পারো না। কেন পারো না? কারণ, তখন পর্যন্ত তোমার ডিলুশনটা পুরো তৈরী হয় নি। হতে পারে, সমস্যাটা আসলে তৈরী করেছে তোমার মা-বাবা। জন্মের পর থেকে তোমাকে এত অসংখ্যবার তারা আনিস নামে ডেকেছে যে তোমার মনে একটা ভ্রান্ত ধারণা জন্মেছে যে তুমিই সেই আনিস। আসলে আনিস বলে কেউ নেই। পুরোটাই মনোবৈকল্য।”
খুব একটা দ্বিমত করতে পারলাম না রকিব সাহেবের দুর্দান্ত যুক্তির সাথে। তার কথাটা সরকারের ঘোষণাগুলির সাথেও মিলে যায়। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে জনগণ তো আসলে পরিসংখ্যান ছাড়া আর কিছু না, অন্যদিকে সংখ্যার চেয়ে বেশি জরুরি হচ্ছে নিয়ম, আর শৃঙ্খলার কারণেই মানবজাতি এতদূর আসতে পেরেছে।
সাড়ে তিনটার দিকে আফতাব স্যার আমাকে ডেকে পাঠালেন। ততক্ষনে আমার কাছে সবকিছু শূন্য মনে হতে শুরু করেছে। মনে হচ্ছিলো, পৃথিবীর কোন কিছুরই কোন অর্থ নেই – আমার শরীরটা একটা বিভ্রম, শুধু আমার মনের একটা ক্ষীণ অস্তিত্ব আছে।
স্যার আমাকে বসতে বললেন। চা অথবা কফি – হবে কিছু একটা – রাখা ছিল টেবিলে, যেখানে আমি বসব সে কোনাটায়। আমি চেয়ারে বসতেই তিনি হাতের ইশারা করলেন আমার সামনের উষ্ণ পানীয়ের দিকে, আমি হেডমাস্টারের রুমে বন্দি হয়ে পড়া বাধ্য স্কুলছাত্রের মতো কফির মগ হাতে নিলাম, সম্মোহিতের মতো চুমুক দিতে শুরু করলাম সেখান থেকে। ভদ্রলোক স্বভাবজাত ধীর-স্থির ভঙ্গিতে কথা বলতে শুরু করলেন।
“আনিস সাহেব, আপনি তো জানেন মানুষ মাত্রই নগন্য, ফলে একজন মানুষকে খুব সহজেই প্রতিস্থাপন করা যায় আরেকজন মানুষ দিয়ে।”
“জি স্যার।”
“আর এখন তো বিজ্ঞানের চূড়ান্ত বিজয়ের সময়। একসময় মেশিন কেড়ে নিয়েছে কারখানাগুলোর চাকরি, এখন কম্পিউটার কেড়ে নিচ্ছে অফিসের চাকরি।”
“জি, স্যার।”
“আমাদের ব্যাঙ্ক একটা সিস্টেম কিনেছে, সেটা অনেকের চাকরি খেয়ে দিবে। আপনি তো জানেন, আপনি যে কাজটা করেন, একটা কম্পিউটারে ডাটা এন্ট্রি দিলে খুব সহজেই সে সেটা নিজে নিজে করতে পারবে। আর সেই হিসাবও হবে নির্ভুল।”
“জি, স্যার।”
“আপনি তো ডাটা এন্ট্রি পারেন না, তাই না? রিজিকের মালিক খোদা তায়ালা। আপনার মতো যারা চাকরি হারাবে, তাদেরও একটা ব্যবস্থা হবে নিশ্চয়ই।”
“জি, স্যার।”
“আপনার কোন বক্তব্য আছে? আপনাকে খুব চিন্তিত মনে হচ্ছে। কি ভাবছেন?”
“স্যার, একটা প্রশ্ন দুপুর থেকে মাথায় ঘুরছে। আপনি তো ধার্মিক মানুষ, আপনি হয়তো বলতে পারবেন।”
তিনি হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লেন। সে সময় তার চোখের দৃষ্টিকে খুব দয়ালু মনে হচ্ছিলো।
চা কিংবা কফি – হবে কিছু একটা – গলায় যাবার কারণেই কিনা জানি না, আমার মনে হলো তন্দ্রা একটু কেটে গিয়েছিলো। গলা পরিষ্কার করে বললাম – “স্যার, রকিব ভাই আমাকে বলেছে, আমার কোন অস্তিত্ব নেই। পুরাটাই নাকি একটা বিভ্রম। উনার কাছে নাকি এর বৈজ্ঞানিক প্রমানও আছে। কিন্তু স্যার, আপনি তো জানেন, উনি একটু নাস্তিক ধরণের। উনার এই কথাটা তো ভুল, তাই না, স্যার? ধর্মের দিকে চিন্তা করলে আমার নিশ্চয়ই কোন ধরণের একটা অস্তিত্ব আছে, ঠিক না, স্যার?”
আফতাব সাহেব চোখ বন্ধ করে আমার কথা শুনছিলেন। বেশ কিছুক্ষন পর তিনি চোখ খুলে তাকালেন আমার চোখে, যেন মোরাকাবা থেকে এইমাত্র জেগে উঠেছেন, অদৃশ্যের জগৎ থেকে ইলহাম নিয়ে হাজির হয়েছেন আমার ভুলে যাওয়ার মতো সামান্য অস্তিত্বের সামনে। অপার্থিব কণ্ঠে বললেন – “রকিবের সব কথা ঠিক না, কিন্তু এই কথাটায় কিছু ভিত্তি আছে। আপনার আসলে কোন অস্তিত্ব নেই। একমাত্র স্রষ্টাই বাস্তব, আর সৃষ্টি মাত্রই অবাস্তব। আপনার একটা অস্তিত্ব আছে, কিন্তু সেটা অবাস্তব ধরণের অস্তিত্ব।”
“আমার কোন অস্তিত্ব নেই? পুরোটাই বিরাট বড় একটা শূন্য?”
“শূন্যও একটা সংখ্যা, তারও মূল্য আছে। আপনি তো একাউন্ট্যান্ট, তো জানা থাকার কথা। শূন্য ছাড়া কি অশূন্যকে প্রকাশ করা যায়?”
আফতাব সাহেবের রুম থেকে যখন বের হয়ে আসছি, তখন মস্তিষ্কের খুব গভীরে একটা চিনচিনে ব্যথা শুরু হয়েছে, আর সেটা চক্রবৃদ্ধি হারে বেড়ে ও চলেছে।
বিকেল পাঁচটার দিকে হঠাৎ করেই সবাইকে বাসায় যেতে বলা হলো। ঢাকা শহরের অবস্থা নাকি ভালো না, লোকজন নাকি বন্যার মতো রাজধানীর দিকে আসছে। সরকারের পতন হয়ে যেতে পারে, এমন সাংঘাতিক অবস্থা।
“বড়ো কোন গন্ডগোল হতে পারে। কোন মানে আছে এসবের? এভাবে অফিস চালানো যায়?” – আমাদের রুমে এসে নিজে থেকে বললেন আফতাব স্যার। আমরা একমত হলাম।
সোয়া পাঁচটার দিকে রুম থেকে বের হওয়ার সময় ফাইন্যান্সের রকিব ভাইয়ের সাথে দেখা হলো করিডোরে। তিনি বলছিলেন – “এগুলি করলে ব্যবসা-বাণিজ্য সব লাটে উঠবে। দেশটা আর স্থিতিশীল হলো না।”
আরো কি যেন বলছিলেন তিনি, ব্যবসাবিজ্ঞানের কোন তত্ত্ব হবে। কিন্তু তার কোন কথা আমার কান দিয়ে ঢুকছিল না, কারণ আমি তার পায়ের দিকে বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম।
আমি তার পায়ের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম, কারণ পায়ের গোড়ালির যেখান থেকে তার ছায়াটা শুরু হওয়ার কথা সেখানে কোন কিছু নেই।
আমি চোখ কচলে আবার তাকালাম। হ্যাঁ, ওই তো তার ব্রিফকেসের ছায়া পড়ছে, কিন্তু রকিব ভাইয়ের কোন ছায়া নেই। আমি কোনমতে দৌড়ে পালিয়ে গেলাম তার সামনে থেকে, মনে হচ্ছিলো আমি রকিব ভাই না বরং তার ভুতকে দেখেছি।
সিঁড়ি দিয়ে সবাই নামছিলো। দারোয়ান নিশ্চিত করছে, শুধু উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা যেন লিফটে উঠতে পারে। সেখানে আরেকবার থমকে দাঁড়াতে হলো আমাকে, কারণ দারোয়ান মিহিরের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন আফতাব স্যার, কিন্তু মিহিরের ছায়ার পাশে স্যারের ছায়া অনুপস্থিত।
সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত নেমে এসে দাঁড়ালাম মতিঝিলের রাজপথে। শাপলা চত্বরের দিক থেকে লোকজন দ্রুত হেটে আসছে। ওই দিকে কেউ যাচ্ছে না, সম্ভবত বোমা-টোমা ফুটেছে। আমি একটা লাইটপোস্টের গোড়ায় দাঁড়িয়ে প্রত্যেকটা পথচারীকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লক্ষ্য করতে থাকলাম।
পশ্চিমে ঢলে পড়তে থাকা কমলা সূর্যের কারণে ছায়াগুলো সব ভীষণ দীর্ঘ, সুতরাং আমার চোখের ভুল হওয়ার কোন কারণ নেই। তার মানে আমি যা দেখছি, তা অবশ্যই সত্য। আর আমি দেখছিলাম, আমার সামনে দিয়ে চলে যাওয়া লোকগুলোর মধ্যে অনেকেরই ছায়া নেই।
হতে পারে, এই ছায়াহীনতা কোরোনাভাইরাসের মতো একটা রোগ, যা আমার মতো এই শহরের অনেককেই আক্রান্ত করে ফেলেছে। ঢাকার বাইরে এটা ছড়িয়েছে কিনা, জানার একমাত্র উপায় শাপলা চত্বরের দিকে যাওয়া। আমি স্রোতের বিপরীতে গোল চক্করটার দিকে হাটতে শুরু করলাম। আমাকে তখন ক্রমাগত অতিক্রম করে মতিঝিল থেকে অজানা গন্তব্যের দিকে পালিয়ে যাচ্ছে অগণিত ছায়াহীন নাগরিক।
