বেশ কিছুদিন থেকেই আমার সন্দেহ শারমিন মারা গেছে।
আমার সন্দেহ একেবারে অমূলক না। জীবিত মানুষের সাথে শারমিনের চলাফেরার আসলেও বেশ কিছু পার্থক্য আছে, যেগুলো আমি ওকে খেয়াল করে করে ধরে ফেলেছি।
পার্থক্যগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ওর ভীষণ অল্প খাওয়া-দাওয়ার অভ্যাস। মৃত বলেই হয়তো সে খাবার খায় অবিশ্বাস্য রকম কম। সারাদিনে এক মুঠো মুড়ি, অথবা একটা ছোট্ট খেজুর, কোনো কোনদিন আধা গ্লাস দুধ-চা – এই খেয়ে সে টিকে থাকতে পারে দিনের পর দিন। এমনকি জানতে চাইলে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে – “আমাদের মতো মানুষের অল্প খেলেই চলে, শুধু চলা-ফেরার জন্য যেটুক শক্তি দরকার, খুব স্বল্প পরিমান শর্করা থেকেই ওটা চলে আসে।“
“আমাদের মতো মানুষের”? কথাটার মানে কি? ও কি তাহলে আমার মতো মানুষ না? অন্য কোন প্রজাতির মানুষ? নাকি সে আমাকে ভয় দেখতে চায়? সে কি মনে করে এসব বললে আমি দ্বন্দ্বে পড়ে গিয়ে তাকে সন্দেহ করা ছেড়ে দেব? খোদা মালুম। কিন্তু সে আমাকে চেনে না, আমি অত সহজে ছেড়ে দেয়ার পাত্র নই।
জীবিত মানুষের সাথে তার আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য হলো ওর হিমশীতল শরীর। ও যখন রাতে খালি গায়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে, মনে হয় একটা কালো অজগর আমাকে তার কুণ্ডলীর ভেতর আটকে ফেলেছে – আমি কিছুতেই নিজেকে ছাড়াতে পারছি না, কেননা সর্পিল নিঃশ্বাস আমাকে তখন সম্মোহিত করে ফেলেছে, আমি হয়ে গেছি তার খেলার পুতুল।
বেশ কিছুদিন থেকেই আমার সন্দেহ শারমিন মারা গেছে, যদিও সে স্বাভাবিক মানুষের মতোই ঘুরে-ফিরে বেড়ায়, খায়-দায়, কাজে যায়, বাজার করে, কপালে কালো টিপ পরে – ফলে বাইরে থেকে যে কেউ মনে করবে সে একজন জীবিত মানুষ। কিন্তু আমি তো তার স্বামী, আমি তো তাকে কাছে থেকে দেখি, আমি তো তার সবগুলো অস্বাভাবিক জিনিস টের পাই – যে কারণে আমার বিশ্বাস দিনের পর দিন দৃঢ় হতে থাকে যে, আমি কোন না কোনভাবে আসলে একটা মৃতদেহকেই বিয়ে করেছি।
এধরণের মানুষকে বিজ্ঞান কল্প-কাহিনীগুলোতে অনেকসময় “জম্বি” বলে ডাকা হয়ে থাকে। যারা বিষয়টা পুরোপুরি জানেন না, তাদের সুবিধার জন্য বলছি – জম্বি হচ্ছে একধরণের মানুষ, যারা এক বিশেষ ভাইরাস বা এরকম কোন একটা কিছুর আক্রমণে মারা গেছে, অর্থাৎ তাদের আত্মা তাদের শরীর ছেড়ে চলে গেছে, কিন্তু সেই বিশেষ জীবাণুগুলোর কর্মকান্ড এরকম যে মৃত মানুষগুলোর শরীর পুরোপুরি চালু আছে মৃত্যু হয়ে যাওয়ার পর এখনো পর্যন্ত।
আত্মাবিহীন সেই শরীরগুলো বেঁচে থাকার জন্য যা যা দরকার সবকিছুই করে, যদিও সামান্য কিছু পার্থক্য থেকে যায়। পার্থক্যগুলো কেউ ধরতে পারে না, খুব কাছের কিছু মানুষ ছাড়া – কাছের মানুষ বলতে বাবা-মা, ঘনিষ্ঠ বন্ধু, রুমমেট, কিংবা স্বামী। সেরকমই এক দুর্ভাগা বন্ধু ও রুমমেট হিসেবে আমি নিশ্চিত, আমি আসলে ভুলবশত একটা মৃত মেয়েকেই বিয়ে করে ফেলেছি।
শারমিনের সাথে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল এক বিয়ের অনুষ্ঠানে – বছর আটেক আগে। বিয়েটা ছিল আমার খালাতো ভাইয়ের – ইসলামপুরে কাটা কাপড়ের ব্যবসা ছিল তার, বাবার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলো।
বিয়ের অনুষ্ঠান আমার ভালো লাগে না, বিয়ের সাথে মৃত্যুর কোথাও একটা মিল আছে। দিব্যজ্ঞানী লোকজনকে বলতে শুনেছি, বিয়ের স্বপ্ন দেখা মানে কাছের কারো মৃত্যু আসন্ন। তাছাড়া বিয়ে আর মৃত্যু দুই উপলক্ষ্যেই অপরিচিত লোকজনের বিশেষ করে পাড়ার মসজিদের মৌলভী সাহেবদের আনাগোনা থাকে। এক উর্দু কবিতায় পড়েছিলাম, বিয়ের কন্যা আর মৃত ব্যক্তি উভয়কেই সাজানো হয়, তারপর উভয়কেই নিজ নিজ ঘরের দিকে যাত্রা করতে বাধ্য করা হয়।
তাছাড়া ছোটবেলা থেকেই এ সমস্ত জায়গায়, এ জাতীয় অনুষ্ঠানে, শত শত মানুষের আনা-গোনা আমাকে ভীত-সন্ত্রস্ত করে। ভদ্রতামূলক মেকি কথা-বার্তা আমার কাছে অর্থহীন মনে হয় বলেই হয়তো বিশেষ করে নতুন মানুষের সাথে পরিচয়পর্ব আমাকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে ফেলে, প্রথম হাত মেলানোর পাঁচ মিনিটের মধ্যে আমার মাথার ঠিক মাঝখানে একটা চিনচিনে ব্যথা শুরু হয়ে যায়।
আরেকটা সমস্যা হলো মানুষের নাম মনে রাখা। মৃত ব্যক্তি যেমন কারো নাম মনে করতে পারে না, ভিড়ের মধ্যে পড়লে একই রকম অবস্থা হয় আমার। আর কারো নাম মনে রাখতে পারি না বলে অনেকেই আমাকে আজব চিজ মনে করে। খালাতো ভাইয়ের সেই বিয়ের অনুষ্ঠানেই এক ভদ্রলোকের সাথে পরিচয় হলো, আমি জানতাম তিনি ডাক্তার, এটাও জানতাম যে সে বউপক্ষের গুরুত্বপূর্ণ কেউ। তিনি কি মনে করে হঠাৎ জানতে চাইলেন – “আচ্ছা মারুফ, আমার নামটা তোমার মনে আছে তো?”
আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। মাত্র পাঁচ মিনিট আগে উনি নামটা বলেছেন। দ্রুত স্মৃতি হাতড়াতে শুরু করলাম, কিন্তু নার্ভাস ছিলাম বলেই হয়তো আমার নিজের মস্তিষ্ক আমার সাথে প্রতারণা শুরু করলো – মনে হলো তার নাম ‘ন’ দিয়ে শুরু, ডক্টর নাজমুল? না, সম্ভবত তার নাম ‘ম’ দিয়ে শুরু, ডাক্তার মোমিনুল?
শেষ পর্যন্ত জানা গেলো, উনার নাম এনামুল। কি লজ্জার কথা ! উনি অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে কিছু না বলেই উঠে চলে গেলেন। আমি ভিড়ের মাঝে একা বসে ছিলাম, আর ভাবছিলাম কি ভাবে আমার সামাজিকতার অভিনয়কে আরো বিশ্বাসযোগ্য করে তোলা যায়। নাম মনে রাখার টিপস সংক্রান্ত কিছু শিক্ষামূলক ভিডিও দেখা যেতে পারে বলে যখন আমার ধারণা দৃঢ় হচ্ছিলো, তখনি আদিল, তারেক আর খালেদ আমাকে ঘিরে ধরে বললো।
আমার এই কাজিনরা, যারা কিনা আমাকে সারাজীবন আঁতেল বলে খেপিয়েছে, তাদের ভেতর সবচেয়ে ছোটজন অর্থাৎ তারেক আমার কানে কানে বললো – আমার এক নারী প্রতিমূর্তি পাওয়া গেছে, কনে পক্ষের লোকজনের মধ্যে।
“তোমার সাথে মানাবে ভালো, মারুফ ভাইয়া ” – বদমাশটা বললো।
ওদের পিছু পিছু আমি এগিয়ে গেলাম। দেখি সে এক কোনে বসে কালো মলাটের মোটা একটা বই পড়ছে, চারিদিকের হৈ-হুল্লোড় তার ভেতর বিন্দুমাত্র প্রভাব ফেলছে না। ওর মধ্যে এমন একটা শান্ত-সৌম্য ভাব ছিল, যে ওর দিকে তাকালেই মনে হচ্ছিলো প্রচন্ড ঝড়ের ভেতর শান্ত একটা ছোট্ট দীঘি।
আপাদমস্তক কালো কাপড়ে ঢাকা বড়ো আর টানা টানা চোখের শ্যামলা মেয়েটার দিকে আমার চোখ আটকে গেলো। মেয়েটা নাকি ভার্সিটিতে খালেদের ক্লাসমেট। ওর দিকে আমাকে অপলক তাকিয়ে থাকতে দেখে খালেদ জানালো – এই মেয়ের সাথে কেউ মেশে না।
“কেন মেশে না?” – ধীর কিন্তু দৃঢ় স্বরে জানতে চাইলাম আমি।
“কারণ অনেক বছর আগে ও একবার মারা গিয়েছিলো।” – খালেদ জানালো ফিসফিস করে।
আমি বুঝতে চেষ্টা করছিলাম, খালেদটা শয়তানি করছে কিনা। কিন্তু ভাবতে ভাবতে অনেক দেরি হয়ে গেল – আমি একসময় বুঝে ফেললাম, আমার নিয়তি লেখা হয়ে গেছে তারপর তকদিরের কলমটাও তুলে নেয়া হয়েছে। আমি ধীর পায়ে তার দিকে এগিয়ে গেলাম, যেভাবে নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও আগুনের দিকে এগিয়ে যায় অন্ধ পতঙ্গ।
এভাবেই ওর সাথে আমার পরিচয়। তারপর থেকে আমরা একসাথেই আছি। বিয়ে করেছি মাস ছয় হয়, তারপর একসময় উঠে এসেছি মতিঝিল কলোনির টিনের ছাদের এই বাসাটায়। শারমিনের মৃত্যুর বিষয়টা সম্পর্কে আমি প্রথম নিশ্চিত হই এই বাসাটাতেই।
দ্বিতীয় শ্রেণীর সরকারি কর্মচারীদের থাকার কথা মতিঝিল মডেল স্কুলের পাশের চারতলা দালানগুলোর কোন একটাতে, কিন্তু কোন ফ্লাট খালি না থাকায় তৃতীয় শ্রেণীর জন্য বরাদ্দ এই একতলা ঘরগুলোর একটাতে এসেই উঠতে হয়েছে আমাদের। ইটের সাদা দেয়াল আর ওপরে ঢেউ টিনের চালের জন্য দূর থেকে টানা বারান্দার বাসাগুলোকে মফস্বলের স্কুলঘরগুলোর মতো দেখাতো, কিন্তু কোন রহস্যময় কারণে শারমিন আর আমার দুজনেরই ভালো লেগে গেলো বাসাটা। বিষয়টা অনেকটা মায়া পড়ে যাওয়ার মতো, আর মায়া তো কংক্রিট আর টিনের পার্থক্য তেমন একটা বোঝে না।
সেই বাসাতেই এক সন্ধ্যায় টিমটিমে হলদে আলোয় দেখলাম, সে ঠোঁটে দিয়েছে কালো লিপস্টিক আর কপালে গোল একটা কালো টিপ। কালোতে যে কাউকে এত সুন্দর লাগতে পারে, সেটা শারমিনকে ওই অবস্থায় না দেখলে আমি জীবনেও বিশ্বাস করতে পারতাম না। কিন্তু ওকে যখন আমি জড়িয়ে ধরলাম, মনে হলো আমাকে গ্রাস করে নিতে শুরু করেছে কালো এক মৃত নক্ষত্র – যদিও এই অবসন্নতাকেই আবার আমার কাছে মনে হলো বিস্ময়কর রকম স্বস্তির, যেন এক গভীর ঘুম আমাকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করছে ব্যাংকের ঋণ আর মুদির দোকানের বাকির খাতা থেকে অনেক অনেক দূরে।
সকালে ঘুমে ভেঙে গেলে জানতে চাইলাম, গতরাতে সে কেন এই অদ্ভুত সাজ-সজ্জা করেছিল। তখনি সে জীবনে প্রথমবারের মতো স্বীকার করলো যে সে আসলে বহুদিন আগে একবার মারা গিয়েছিলো, কালো আর অন্ধকারের প্রতি তার অসীম আগ্রহের কারণও সেটাই।
তার কথা বিশ্বাস করতে কষ্ট হলো আমার, তবুও কথা চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। সে যদি মানসিকভাবে অসুস্থ হয়, তাহলে তাকে সাহায্য করার জন্য হলেও আমাকে ওর সাথে কথা বলতে হবে, অর্থাৎ ওকে বিশ্বাস করার অভিনয় করে যেতে হবে।
সে অবশ্য বললো, সে জানে না ঠিক কবে কখন সে মারা গেছে। প্রথম বিয়ে বার্ষিকীর দিন মেঘলা সেই বিকেলে কালো কফিতে চুমুক দিতে দিতে তাকে চেপে ধরলাম জানার জন্য, ঠিক কোন দিনে তার মৃত্যু হয়েছিল। আমরা যেমন জন্মদিন পালন করি, সম্ভবত ঠিক সেইভাবে তার মৃত্যুদিনও আমরা পালন করতে পারতাম।
কিন্তু প্রশ্ন শুনে তাকে অন্যমনস্ক হয়ে যেতে দেখলাম। বুঝতে পারলাম, সে আসলেও মনে করতে পারছে না তার মৃত্যুর সঠিক দিন-ক্ষণ। বেশ কিছুক্ষন চিন্তায় ডুবে থেকে শেষে বললো – “মনে হয় একটু একটু করে মারা গেছি আমি।“
কথাটা আমার কাছে যুক্তিযুক্তই মনে হল। এটা তো খুবই সম্ভব যে মৃত্যু আসলে হঠাৎ করে ঘটে যাওয়া কোন একটা দুর্ঘটনা নয়, বরং মানুষ প্রতি মুহূর্তেই মারা যায় আংশিকভাবে। আমার স্কুলের বন্ধু রাশেদ যেদিন ইতালি চলে গেলো, আমার ভেতর একটা অংশ কি সেদিন মারা যায় নি? অবশ্যই মারা গিয়েছে। কলেজে ভর্তি হয়ে যেদিন বাবার ছায়া আর মায়ের আঁচলের নিচ থেকে বের হয়ে এসে দাঁড়ালাম এই ব্যস্ত শহরে, সেদিন কি আমি আরো একবার নতুন করে মারা যাই নি?
গতকালকের আমি আর আজকের আমি তো এক ব্যক্তি না, তাহলে কি মাঝখানে রাতের বেলা অন্তত একবার আমার মৃত্যু ঘটে নি? গতকালের আমি যদি রাত্রের ঘুমের মধ্যে মারা না যেতাম, তাহলে আজকের এই নতুন আমি জন্মাতাম কি করে, তাই না?
আমি যে একটা মৃত মানুষের সাথে বাস করছি, তার সাথে সখ্যতা ও সহবাস করছি, এই জিনিসটা সেই দিনগুলোতে মাঝে মাঝেই আমাকে অস্বস্তিতে ফেলে দিতো। ফলে ভোরবেলা ঘুম ভেঙে গেলে মনে হতো, এই ঘরে তো আমি একা, কেননা আমার পাশে শয্যা নেয়া এই কালো গোলাপটা তো আসলে অনেক দিন আগেই ঝরে গেছে জীবন নামের গাছ থেকে। সন্ধ্যার সময়ও নিজেকে অসহায় আর শূন্য মনে হতো। দিনের পর দিন এভাবে একাকিত্ব গ্রাস করতে লাগলো আমাকে, ফলে আমি কিছুটা একরোখা হয়ে উঠতে শুরু করলাম।
আমি জানতাম, একজন জীবিত মানুষ কখনোই একজন মৃত মানুষের সাথে বেশিদিন থাকতে পারবে না। একসময় না একসময় তার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙবেই। এরকমই এক ঘোলাটে রোদের দিন তাকে দিশেহারা আমি কঠিন স্বরে জিজ্ঞেস করে বসলাম – কালো কেন তার পছন্দের রং, অন্ধকার কেন তার ভালো লাগে। সে বললো – “কালোই সত্য, আর অন্ধকারই বাস্তব, আলো হচ্ছে শুধুই বিভ্রম।“
আমি বললাম – “সরি শারমিন, মানতে পারলাম না। আমি তো শুনেছি, আলো হলো পৃথিবীর আয়নায় ঈশ্বরের ছায়া।“
“ঈশ্বর কে?”
“ঈশ্বর হচ্ছেন তিনি, যিনি মৃত শরীরে জীবন দান করেন। মনে রেখো, মৃত্যুর সৃষ্টি কিন্তু জীবনেরও আগে। তোমার কি মনে হয়, আমি ভুল শুনেছি? বা এগুলি সব ভুল ধারণা? কুসংস্কার?“
সে ভারাক্রান্ত কণ্ঠে যা বললো, তার সারমর্ম হল – এই শহরের মানুষ ঈশ্বরকে মেরে ফেলেছে, যেন তাদের নীতি-নৈতিকতা এসব নিয়ে ভাবতে না হয়, যেন তারা নীল আকাশে ডানা মেলা পাখির মতো জীবনকে অনুভব করতে পারে।
“আসল কথা হল, এই যুগে আলো, রংধনু, এসব নিয়ে আলোচনা করা খুবই অপ্রাসঙ্গিক।” – সে বললো।
তার এসব কথা-বার্তা সবসময়ই আমার এন্টেনার অনেক ওপর দিয়ে চলে যায়, ফলে দিনের পর দিন এই মানসিক অস্বস্তিটা আমার মাথার ভেতর আক্রমণ করে যেতে থাকে। একসময় আমি আর নিতে পারি না, আমার মনে হতে থাকে কিছু একটা করতেই হবে আমাকে। সম্ভবত প্রথমে আমাকে যেটা পরীক্ষা করতে হবে সেটা হলো পরীক্ষা করা যে, সে আসলেই মৃত কিনা। সব সন্দেহের অবসান হবে তখনই। আর আমি জানতাম, কেউ মৃত না জীবিত সেটা পরীক্ষা করার সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো তাকে হত্যা করা, তাকে মেরে ফেলার চেষ্টা করা।
সে যদি মৃত হয় – যেমনটা সে দাবি করে থাকে – তাহলে তো তার কিছুই হবে না, হয়তো পরের কয়েকটা দিন হাসাহাসি করবে আমাকে নিয়ে। সেটা সে করুক, আমার তেমন একটা আপত্তি নেই এসব ঠাট্টা-মস্করাতে।
অন্যদিকে সে যদি জীবিত হয়, তাহলে সেটা হবে খুন – দুঃখজনক একটা খুন। সেক্ষেত্রে আমি জেলে যাবো। কিন্তু তাতে আমার আপত্তি থাকার কথা না, অন্ততপক্ষে মুক্ত তো হতে পারবো সাইনাসের ব্যথার মতো তীব্র ভীষণ এই মানসিক যন্ত্রণা থেকে।
যেই ভাবা সেই কাজ। সে দিন থেকে, সে রাত থেকে শারমিনকে খুন করার জন্য নানা উপায় খুঁজতে লাগলাম আমি। মানুষ খুন করার বিভিন্ন প্রক্রিয়া সতর্কভাবে পর্যালোচনা করার পর আমার মনে হলো, বালিশ চাপা দিয়ে তাকে মেরে ফেলাটাই হবে সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত উপায় – কেউ বুঝবে না, ভাববে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু ঘটেছে।
সেদিন থেকে, সেরাত থেকে মানুষ খুন করার বিভিন্ন প্রক্রিয়া সতর্কভাবে পর্যালোচনা করার পর
ওকে হত্যা করার পদ্ধতির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলার পর আমার মন কিছুটা শান্ত হল, তখন আমার মনোযোগের কেন্দ্র হলো সঠিক দিন-ক্ষণ খুঁজে বের করা, আর খুঁজতে খুঁজতে একসময় দারুন একটা সুযোগও মেলে গেলো চৈত্র মাসের দ্বিতীয় পূর্ণিমার রাতে।
সে রাতে ভ্যাপসা একটা গরম ছিল বলে, আর এর মধ্যে লোড শেডিং হয়ে যাওয়াতে, সে ঘুমাচ্ছিলো জানলার ঠিক পাশে। আকাশ থেকে জোৎস্নার তীব্র আলো ভারী বৃষ্টির মতো নেমে এসে ভাসিয়ে দিচ্ছিলো তার মায়াবী মুখকে। চাঁদের আলোর মমতায় পুড়ে পুড়ে তাকে তখন অচেনা অতিথির মতোই অপরূপা লাগছিলো।
যখন নিশ্চিত হলাম তার নিঃশ্বাস বেশ ভারী অর্থাৎ তার ঘুম বেশ গাঢ়, আমি তার পাশে উঠে বসলাম, কিছুক্ষন চোখ বন্ধ করে মনের খুব গভীরে শক্তি সঞ্চয় করলাম, তারপর সুযোগ বুঝে হঠাৎ তার মুখে বালিশ চেপে ধরলাম। সে নড়ে-চড়ে উঠলো বালিশের নিচে, কিন্তু আমি হাল ছাড়লাম না – শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে তাকে চেপে ধরে রইলাম, কতক্ষন মনে নেই – মনে হয় অনন্তকাল।
তাকে ছেড়ে দিলাম, যখন বালিশের নিচ থেকে তার হাসির শব্দ শুনলাম। বালিশ সরিয়ে দেখলাম সে মায়াভরা চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। সস্নেহ হাসিতে আমাকে সিক্ত করে করুন কণ্ঠে সে বললো – “মৃতকে কি কখনো মেরে ফেলা যায়?”
লজ্জা পেয়ে আমি তাকে ছেড়ে দিলাম। তারপর এক কাপড়ে ঘর ছেড়ে বের হয়ে হাটতে শুরু করলাম, যেদিকে দুচোখ যায় তার উল্টোদিকে। পাড়ার নেড়ি কুকুরগুলো আমার দিকে তাকিয়ে অনেকক্ষন তারস্বরে চেঁচালো, কিছুটা সময় ধরে ধাওয়া করলো, তারপর একসময় হাল ছেড়ে দিয়ে সটকে পড়লো যে যার পথে।
এরপর বহুদিন পথে পথে ঘুরেছি। কখনো বিনা টিকেটের যাত্রী হয়ে আন্তনগর ট্রেনে, কখনো তাবলীগ জামাতের সাথে তিন চিল্লাতে, কখনো মাজারের খাদেম সেজে পলাতক হয়ে। কিন্তু মানুষ মরণশীল, রাজপথের তীব্র প্রতিবাদও একসময় পথ হারায় – একসময় আমার শক্তিও ফুরিয়ে এলো, অমোঘ নিয়তির মতো শারমিনের আকর্ষণ ফিরিয়ে নিয়ে চললো আমাকে নস্টালজিয়ার ওই ঘরে।
সেদিনের পর থেকে সবকিছু মেনে নিলাম আমি। হোক না সে মৃত, আমার বিবাহিতা স্ত্রী তো সে। যেমনই হোক না সে, তাকে আমার মেনে নিতে হবে। নিয়তির মতোই অমোঘ সে আমার জন্য, শত হলেও আমার পাঁজরের অংশ সে।
ঘরে ফিরেই লক্ষী ছেলের মতো স্বাভাবিক জীবন-যাপন শুরু করলাম মরহুমা শারমিন আক্তারের সাথে আমি, মন থেকে ঝেড়ে ফেললাম সমস্ত বিশ্বাস আর কুসংস্কার। এমনকি একসময় বাবা-মাকেও জানালাম শারমিনের সাথে এতদিন গোপন করে রাখা আমার বিয়ের কথা।
আমার বাবা গৌরীপুর হাই স্কুলের বিজ্ঞান শিক্ষক আফসার আলীর ভীষণ আপত্তি ছিল এই বিয়েতে। বাবার ধারণা ছিল – এই মেয়েকে বিয়ে করলে, ওর সাথে ঘনিষ্ঠ হলে আমিও আক্রান্ত হবো একই অসুখে, তারপর একসময় এই মৃত্যুরোগ গ্রাস করবে আমাকেও – যদিও এই ধারণার কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি ছিল না।
বাবার বিশ্বাস ছিল – মৃত্যুচিন্তা, মৃত্যুভয়, এসব নিয়ে বেশি পেরেশান হলে দরকারি দুনিয়াবী কাজকর্ম করা তো অসম্ভব হবেই, আখিরাতেরও বারোটা বাজবে, কেননা শয়তান ভয় আর হতাশা দিয়েই মানুষকে বিভ্রান্ত করতে ভালোবাসে। সেকেলে এই ভদ্রলোকের বিশ্বাসগুলো ছিল এরকমই অমূলক আর বিভ্রান্তিকর।
আমার গৃহিনী মা মোমেনা বেগমের অবশ্য এ বিয়েতে খুব একটা সমস্যা ছিল না। তার কথা ছিল – একদিন না একদিন তো মৃত্যু আসবেই, যে কয়দিন বেঁচে থাকে ছেলেটা সুখী হয়েই বাঁচুক। যাকে মন থেকে ভালোবেসেছি, তাকে বিয়ে না করলে যে আমি জীবনেও সুখী হবো না, সেটা মা ভালো করেই বুঝতে পেরেছিলেন – তাইতো তিনি ছিলেন আমার স্বাধীন ইচ্ছের পক্ষে।
সব মিলিয়ে বাবার সাথে আমার দূরত্ব বাড়তে শুরু করলো সেই গ্রীষ্মে। সে দিনগুলোতে শারমিনের প্রতি যত ঘনিষ্ঠ হচ্ছিলাম, বাবা এমনকি মায়ের কাছ থেকেও ততই দূরে চলে যাচ্ছিলাম। আসলে আপনি পূর্ব দিকে যতটা এগুবেন, পশ্চিম দিক থেকে ততটাই দূরে সরে যাবেন – এটাই তো বাস্তবতা, তাই না? এভাবে চলতে চলতে অবস্থা একসময় এমন হলো যে, বাবা বুঝতে পারলেন, এ বিয়ে ভাঙ্গানো আর সম্ভব না।
তখন থেকে তিনি সেটাই করলেন যেটা ওই আমলের বাবারা করতে পছন্দ করতেন। তিনি আমাকে ত্যাজ্য ঘোষণা করলেন। জানিয়ে দিলেন, আমি যেন তার সাথে আর কোনদিন কোন যোগাযোগের চেষ্টা না করি। মা কষ্ট পেলেন, ধারণা করি। তবে তিনি সেটা নীরবে মেনে নিলেন, এটাও ধারণা করি। ধারণা করা ছাড়া আমার আর কোন উপায় ছিল না, কেননা বাবা আমার ফোন ধরা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। আর ঢাকার সাথে কুমিল্লার সড়ক ও নৌ যোগাযোগ তো প্রায় পুরোই বন্ধ ছিলো সেই সময়।
সত্যি কথা বলতে, আমিও ছিলাম আমার বাবার মতোই একগুঁয়ে – যা মাথায় ঢুকেছে, তা শেষ পর্যন্ত দেখতে চাইতাম আমি। আমি মনে করতাম – জীবনমুখী হতে হলে প্রথমে উদ্ঘাটন করতে মৃত্যুর রহস্যকে, জীবনকে জানতে হলে আবিষ্কার করতে হবে মৃত্যুর সংজ্ঞাকে। আমাদের ধর্মেই তো বলা হয়েছে – মৃত্যুর সৃষ্টি জীবনেরও আগে, মৃতদেহ প্রাণ পায় শুধু তখনি যখন খোদা তাতে জীবন ফুঁকে দেন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল – শারমিনের সান্নিধ্যে এলেই শুধু আমি বুঝতে পারবো, কিভাবে মৃত্যুর পরও বেঁচে থাকা যায়। বলা যায় না, সেটাই হয়তো আমাকে দেবে চিরজীবী হওয়ার গোপন বিজ্ঞানসম্মত চাবিকাঠি।
এদিকে বাবা-মার সাথে কথা-বার্তা পুরোপুরি বন্ধ হওয়ায় আমার বেশ সুবিধাই হলো তখন – আমি শারমিনকে পুরোপুরি সময় দিতে পারি, দিন-রাত তাকে নিয়ে গবেষণা করে সময় কাটাতে পারি।
শারমিন এসেছিলো অবস্থাপন্ন ঘর থেকে, তার বাবা ছিল ব্যবসায়ী – পাবলিক ওয়ার্কসের নথিভুক্ত কন্ট্রাক্টর। আমার বাবার মতো মাসিক বেতনে তাদের সংসার চলতো না, নেত্রকোনায় আমার শ্বশুরের ছিল তিন তিনটা চারতলা বাড়ি। কিন্তু অর্থের প্রতি শারমিনের কোন মোহ ছিল না, সে মনে করতো – তার পিতার ব্যবসায়িক সাম্রাজ্যের পেছনে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে আছে মৃত্যুভয়।
“কিভাবে?” – জানতে চাইতাম আমি। উত্তরে সে বলতো – “বাবা জানে সে মরে যাবে, তাই সে সম্পদ গড়ে তুলে বেঁচে থাকতে চাচ্ছে সেই সম্পদের মাঝে, কামাই করা নাম-যশের মাঝে, নিজের নামে মাদ্রাসা করে। কিন্তু এসবই নিজেকে নিজে ফাঁকি দেওয়া, কারণ মরলেই সবকিছু শেষ।“
“আমি তো শুনেছি, আমাদের বাবারা টিকে থাকে তাদের ছেলে-মেয়েদের ডিএনএ-র মধ্যে। সে তোমার মধ্যে বেঁচে থাকতে পারতো?”
“না, পারবে না, কারণ আমি তো মারা গেছি।”
“ও,” – আমি ভুলেই গিয়েছিলাম ক্ষনিকের জন্য – “তাহলে আমরা আমাদের এই জীবন নিয়ে করবোটা কি?”
“আমাদের শেখা উচিত, কিভাবে এই ছোট্ট জীবনটাকে উপভোগ করতে হবে।“ – একটুও দেরি না করে সে উত্তর দিলো, যেন সে অদৃশ্য কোন নোটবইয়ের মাধ্যমে জানতো আমি এই প্রশ্নটা তাকে করবো।
সে সত্যিই কিন্তু আমাকে শেখাতো, মৃত হয়েও কিভাবে জীবনকে উপভোগ করা যায়। প্রতি শেষরাতে তার শীতল মৃতদেহকে পেঁচিয়ে ধরার চেষ্টা করতে করতে একসময় আমার অবস্থা এমন হলো যে, আমি চিন্তাই করতে পারতাম না, পুরুষরা কিভাবে উষ্ণ নারীশরীরের সাথে প্রেম করে।
এভাবে চলতে চলতে আমিও একসময় ভালোবাসতে শুরু করলাম মৃত্যুকে। আমারও পোশাকে এলো পরিবর্তন, উজ্জ্বল হাওয়াই শার্টের বদলে ততদিনে আমি পরতে শুরু করেছি সাদা পাজামার সাথে কালো পাঞ্জাবি আর কালো নেটের টুপি। তার গুরুগম্ভীর কণ্ঠে মৃত্যুর বাণী আর মৃত্যুবিষয়ক আলোচনা শুনতে শুনতে একসময় আমি বুঝতে পারলাম, মাটির ওপরের অস্তিত্বের চেয়েও বড় সত্য মাটির নিচের অস্তিত্বহীনতা।
সেবছরই বৈশাখের এক তপ্ত দুপুরে গোসল সেরে এসে সে মাথা নিচু করে আমাকে বললো, তার একটা সুসংবাদ আছে। আমাদের ঘর অন্ধকার করে খুব শিগগিরই আসছে একজন অতিথি।
খবরটা শুনে চমকে উঠলাম আমি। কখনো ভাবিনি, মৃত একজন নারী সন্তান ধারণ করতে পারবে তার গর্ভে। আসলে রহস্যময় এ পৃথিবীর কতটুকুই বা আমরা জানি!
সে রাতে অনেকক্ষণ জেগে থেকে বারান্দায় বৃষ্টির শব্দ শুনলাম। একটু পর পর চমকে উঠলাম এই ভেবে যে, সম্ভবত পৃথিবীতে জন্ম নিতে যাচ্ছে একজন মৃত উত্তরপুরুষ, কেননা একজন মৃত নারীর অস্তিত্ব জন্ম দিতে পারে শুধুই আরেকটা মৃতদেহকে। অমোঘ নিয়তির মতোই সত্য এটা।
সে রাতে অন্ধকারের ভেতর বসে থেকে স্ট্রিটলাইটের ওপর বৃষ্টির অঝোর ধারা দেখতে দেখতে আরেকটা ভয়াবহ সম্ভাবনা উঁকি দিয়ে গেলো আমার মনে। আমার মনে হলো – শারমিন যদি জীবিত মানুষের বেশ ধরে দিব্যি চলে-ফিরে বেড়াতে পারে এই শহরের পথে-ঘটে, তাহলে অসম্ভব না যে এই শহরে হেটে-চলে বেড়ানো অনেকেই হয়তো ওর মতোই মৃত। এখানে কেউ কাউকে চেনে না বলে বিষয়টা ধরা পড়ে না, না হলে বহুদিন আগেই এ শহরের নাম হয়ে যেন মৃতদের নগরী।
এমনকি হয়তো আমি নিজেও মৃত, নিজের অজান্তেই মারা গেছি কোন অদূর অতীতে, আর পুরোনো এই শহরে প্রতিদিন বয়ে নিয়ে চলেছি আমার এই মৃতদেহ। কে বলতে পারে? তবে সত্যি কথা বলতে কি, আজকাল বিষয়টা তেমন আলোড়িত করে না আমাকে।
এই মধ্যবয়সে এসে আমি একটু একটু করে বুঝতে শিখেছি – প্রতিটা মানুষের ভেতর আছে একটা করে শরীর, আর প্রতিটা শরীরের ভেতর আছে একটা করে লাশ সম্ভাব্য। বিজ্ঞানের কল্যানে এখন যেহেতু মানবমৃত্যুর হার আগের চেয়ে অনেক কম, সেই হেতু আজকের পৃথিবীতে লাশের সংখ্যা ক্রমশ বেড়ে চলেছে, ক্রমশই বেড়ে চলেছে।
সেদিন এই বোধোদয়ের পর থেকে সমস্ত আমোদ-প্রমোদ, নাটক-সিনেমা, এমনকি খানা-পিনা ছেড়ে দিলাম। এক বছরের মধ্যে বাড্ডার জমি বিক্রি করে সেই টাকা দিয়ে আজিমপুর কবরস্থানে (নতুন) নিজের জন্য একটা কবরের জায়গা কিনলাম, তারপর সেখানে গর্ত খুঁড়ে থাকতে শুরু করলাম।
প্রায় সাড়ে তিন মাস ছিলাম ওই কবরে একটা অস্থায়ী খুপরি বানিয়ে থেকে। সেখানে চাটাইয়ের ওপর শুয়ে শীতে কাপলাম, বর্ষায় ভিজলাম। দৈনিক যুগের কণ্ঠ থেকে সাংবাদিক এলো আমাকে দেখতে। গ্রাম থেকেও কিছু মানুষ অসুখ-বিসুখ নিয়ে তদবির করতে আসা শুরু করলো। মনে হলো, আধ্যাত্মিক ক্ষমতার নাগাল হয়তো আমি প্রায় পেয়ে গেছি।
সেরকম এক রাতে আকাশে ছিল পূর্ণ চাঁদ। আশেপাশের বিল্ডিঙের আলো বেশিরভাগই নিভে গেছে। যে দুএকটা ঘরে হলুদ আলো জ্বলছে, সেগুলোর আলো কাঁঠাল গাছের বাধা অতিক্রম করে আমার ছাপড়া ঘর পর্যন্ত পৌঁছাতে পারছে না।
তখনি দেখলাম বাবাকে। বুঝলাম না, বাবা আমার ঠিকানা জানলো কি করে, সে তো কখনো আমার মতিঝিলের বাসায় আসে নি। তার সুন্নতি দাড়ি আগের চেয়ে দীর্ঘ হয়েছে, চাঁদের আলোয় বুক পর্যন্ত নেমে আসা সে রুপালি দাড়িতে ঝিলিক দিচ্ছে নূর। তিনি আমার কবরের পাশে এসে হাটু গেড়ে বসে আমার নাম ধরে ডাকলেন, ঠিক যেভাবে ছোটবেলা ঘুম থেকে ডেকে তুলতেন মাদ্রাসায় যাওয়ার জন্য। তার স্বরে ক্রোধ বা হতাশার কোন সুর শুনতে পেলাম না কোন। আমি তাকে সালাম জানালাম।
সালামের উত্তর দিয়ে তিনি কিছুক্ষন আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন, তারপর সস্নেহ হাসি উপহার দিয়ে বললেন – ” মারুফ, বাবা, শোনো, কবর হলো এই দুনিয়া থেকে ওই দুনিয়াতে যাওয়ার একটা দরজা মাত্র। দরজায় কি মানুষ ঘুমায়? বোকা কোথাকার।”
বলে তিনি চলে গেলেন, যেদিক থেকে এসেছিলেন তার বিপরীত দিকে। পূর্ণিমার আলোতে তাকিয়ে দেখি, তিনি যে জায়গায় বসেছিলেন সেখানে জন্মেছে কচি ঘাস। অথচ একটু আগেও সেখানে ছিল শুষ্ক প্রাণহীন এঁটেল মাটি।
আমি তার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। কতক্ষন এভাবে দাঁড়িয়ে ছিলাম, মনে নেই। হঠাৎ মনে হলো, কোত্থেকে যেন সোঁদা মাটির মতো মিষ্টি একটা গন্ধ আসা শুরু করেছে। ওই নতুন ঘাস থেকেই আসছিলো অপার্থিব সেই গন্ধ।
আমার মাথায় কি হলো কে জানে। আমি উঠে দাঁড়ালাম, হাটতে শুরু করলাম মতিঝিলের দিকে। মনে হলো, অনন্তকাল হেঁটেছি। একসময় পৌঁছে গেলাম শারমিনের খুব কাছাকাছি। কড়া নাড়ার আগেই সে দরজা খুলে দিলো, যেন অতীন্দ্রিয় কোন ক্ষমতাবলে সে জানতো যে আমি আসছি।
ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করতেই সে ভুলে যাওয়া প্রেতাত্মার মতো দুবাহু উন্মুক্ত করে এগিয়ে এলো আমার দিকে। আমিও বহুরাত পর শীতল প্রেমের আলিঙ্গনে আবদ্ধ করলাম তাকে। কালো ঠোঁটে আমার কপালে চুমে খেয়ে সে জানতে চাইল কেমন আছি।
আমি তাকে জড়িয়ে ধরলাম পরমাত্মীয়ের মতো, শান্ত কণ্ঠে বললাম – “শারমিন, আজকে আমি জেনে ফেলেছি জীবন আর মৃত্যুর রহস্য।”
“মৃত্যু কি?” – সে সন্ত্রস্ত কণ্ঠে জানতে চাইলো।
“মৃত্যু হলো শুধুই একটা দরজা। দরজায় বসে জীবন কাটানো যায় না। বাঁচতে হলে তোমাকে বসতে হবে হয় এই ঘরে, না হয় ওই ঘরে।”
“ওই ঘর কোথায়?”
“ওই ঘর দরজার ওপাশে।”
“দরজার ওপাশে কি আছে?” – ভয়ে তখন তার মুখ শুকিয়ে হয়ে গেছে কাগজের মতো সাদা।
“দরজার ওপাশে আছে আসল পৃথিবী, আর আসল পৃথিবীতে আছে আসল সুখ। এপাশের ঘরে শুধুই আছে শরীর, আর ওপাশের ঘরটাই আত্মার আসল ঘর।”
শারমিন কিছু বললো না, কিন্তু তার অন্ধকার দৃষ্টিতে দেখলাম আতঙ্ক। হঠাৎ দেখলাম এটা শোনার সাথে সাথে ওর মধ্যে ভীষণ একটা পরিবর্তন শুরু হলো। তার শরীরে খিঁচুনির মতো একটা কিছু শুরু হয়েছে, সে কাঁপছে ভয়াবহভাবে, যেন ভেতর থেকে কেউ তাকে একেবারে শেষ করে দিচ্ছে। এভাবে দেখতে দেখতে আমার বাহুতে সে ঢলে পড়লো, আর আমি জানলাম – মৃতেরও একধরণের মৃত্যু আছে, মৃত্যুকুমারীরও দ্বিতীয় মৃত্যু হয় কখনো কখনো।
সেই থেকে একাই আছি এই বাসায়, মৃত্যুর স্মৃতি আর জীবনের আশা নিয়ে।

মৃত্যু জিনিসটা বোধ হয় আমাদের কাছে ততদিনই খুব বড় একটা বিষয় থাকে যতদিন আমরা শরীর সর্বস্ব সরল জীব হিসাবে বাঁচি। যদি কখনো আমরা বুঝতে পারি যে আমরা আসলে এক ধরনের যৌগিক বা জটিল অস্তিত্ব যা দেহ, মন, এবং আরও অন্যান্য প্রেক্ষাপট এবং অংশের সমন্বয়, তখন মৃত্যুটা আস্তে আস্তে ছোট হয়ে আসে, বড় হয়ে ওঠে লম্বা রাস্তাটা যা আমাদের সামনে আর সেই সম্পর্ক গুলো যা শরীরেরে সাথে জড়িয়ে আমাদের জটিল করে রেখেছে।
LikeLike