ছায়া কিংবা পরীর গল্প

প্রাক-কথন

বিয়ের আগে ছোট বাচ্চাদের দেখলে হামিদের প্রচন্ড গা জ্বালা করতো। তার নিজের ভাতিজা, মানে মারুফ ভাইয়ের পাঁচ বছরের ছেলে রওশন যখন জিদ করে কান্না শুরু করতো, হামিদের মনে হতো একটা চটকনা দিয়ে ওর ঘ্যান ঘ্যান বন্ধ করে দেয়। এমনি ছিল শিশুদের প্রতি হামিদের মনোভাব।

এসব কারণেই হামিদের দুশ্চিন্তার সীমা রইলো না, যখন সে জানলো যে বেলা অন্তস্বত্তা। তার মাথায় রীতিমত আকাশ ভেঙে পড়লো। সে কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিলো না, কি করে আস্ত একটা জলজ্যান্ত বাচ্চাকে সে চব্বিশ ঘন্টা নিজের ঘরের ভেতর নিজের চোখের সামনে সহ্য করবে।

কিন্তু নিয়তির কি খেলা, সেই হামিদই একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে অন্য মানুষ হয়ে গেলো, যখন বেলার কোল জুড়ে এলো শায়ান। এই ছোট্ট ভদ্রলোকটা যখন পিট পিট করে তার দিকে তাকাতো আর কোলে নেয়ার সাথে সাথে তার নাক ধরার চেষ্টা করতো, তখন হামিদের মতো পাষান লোকের পক্ষেও পৃথিবীর বুকে নবাগত এই ব্যক্তিকে ভালো না বেসে থাকা সম্ভব ছিল না – এমনকি সে ওর শার্টে বাথরুম করে দিলেও না।

ছেলেকে সে যে শুধু আপনই করে নিলো তা না, শায়ানের বয়সী অন্য সব ছেলে বাচ্চার প্রতিও তার অশেষ মমতা প্রকাশ পেয়ে যেতে লাগলো। এক সকালে পত্রিকায় ফিলিস্তিনের মৃত শিশুদের মধ্যে শায়ানের বয়সী একটা বাচ্চা ছেলের ছবি দেখে তার চোখে জল টলটল করে উঠলো। আশে-পাশে কেউ আছে কিনা, অথবা কেউ তার পুরুষত্বের ভেতর দুর্বলতা আবিষ্কার করে ফেললো কিনা, সেটা পরীক্ষা করতে করতে সে অতি সন্তর্পনে দক্ষতার সাথে চোখ মুছে ফেললো। অথচ এই সেই পাষান শিমার হামিদ, মা মারা যাওয়ার পরও যার চোখে কেউ পানি দেখতে পায় নি।

সব মিলিয়ে, খোদার অসীম দয়ায়, স্ত্রী বেলা আর ছেলে শায়ানকে নিয়ে ঢাকার শান্তিনগর এলাকায় ছোট একটা পরিবার আর আজাদ গ্রূপ অফ ইন্ডাস্ট্রিজে অ্যাকাউন্টেন্টের ছোট একটা চাকরী নিয়ে হামিদের দিনকাল ভালোই কেটে যাচ্ছিল। কিন্তু সুখের সময়গুলো দ্রুত অতিবাহিত হয়। ফলে সে বছরগুলোতে – ধাবমান হরিনের মতো সেই মাসগুলোতে – হামিদের মনে হচ্ছিলো, সোনালী দিনগুলো যেন উড়ে উড়ে দূরে কোথাও ধরা-ছোঁয়ার বাইরে চলে যাচ্ছে, কিছুতেই তাদের খাঁচায় ধরে রাখা যাচ্ছে না।

কিন্তু নিন্দুকেরা বলে, মুখপোড়ারা বলে – যায় দিন ভালো, আসে দিন খারাপ। আর এটাতো সত্যি যে, প্রত্যেকের জীবনেই কখনো না কখনো কঠিন সময় আসে। হামিদের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হল না। শায়ানের বয়স যখন চার বছর, সেই সময়টাতে হামিদের জীবনে রাগ হয়ে যাবার সমস্যাটা আবার ফিরে আসতে শুরু করলো। সে অল্পতেই রেগে যেত, আর একবার রাগ উঠে গেলে আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারত না।

এই যেমন হয়তো রিক্সাওয়ালা ভাংতি নিয়ে ঝামেলা করল আর অমনি ওর মাথায় রক্ত চড়ে গেলো। বাপের বয়সী রিক্সাওয়ালা চাচার দাড়ি ধরে চড় মেরে গণপিটুনি খেতে বসেছিল সে, পরে কোনোমতে এলাকার পরিচিত ছাত্র নেতাদের হস্তক্ষেপে সেদিনের মত সে রক্ষা পায়।

আরেক সন্ধ্যায় বেলাদের দিকের এক আত্মীয়ার বিয়ের অনুষ্ঠানে তার এক শালা তার সাথে মস্করা করে কিছু বলল। আর যায় কোথায়! তার সেই কথা মাটিতে পড়তে না পড়তেই হামিদ সবার সামনে বেচারার কলার চেপে ধরল। বেলা সে রাতে ভীষণ বিব্রত হয়, কিন্তু সে বুঝতে পারছিল না কিভাবে সে হামিদকে সাহায্য করতে পারে।

এরই মধ্যে একদিন হামিদ শায়ানকে চড় মেরে বসল। বাচ্চাটার ওপর সেদিন ওর রাগের কারণটা কিন্তু ছিল সামান্যই – ছেলেটা তার হিসাবের খাতায় আঁকাআঁকি করে খাতার বারোটা বাজিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু সেটাতেই হামিদ এতো রেগে যায় যে ওকে বেশ জোরে একটা থাপ্পড় দিয়ে বসে – এত জোরে যে শায়ানের মাথা গিয়ে দেয়ালে বাড়ি লাগে, মাথা ফেটে যায়।

হতভম্ব হামিদকে বাসায় রেখে বেলা একটা রিক্সা নিয়ে শায়ানকে কাছাকাছি আনোয়ারা ক্লিনিকে নিয়ে যায়। সদ্য এমবিবিএস পাশ করা ডিউটি ডাক্তার শায়ানের মাথার একপাশের চুল চেঁছে ফেলে তিনটা সেলাই করে দেয়, তারপর বেলাকে আশ্বস্ত করে বলে যে ভয়ের কোন কারণ নেই।

বেলা এ পর্যন্ত হামিদের এসব অনেক সহ্য করেছে। কিন্তু ছেলের রক্ত দেখে তার সমস্ত ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়। ক্লিনিক থেকে বাসায় না ফিরে সে শায়ানকে নিয়ে এক কাপড়ে চলে যায় মিরপুরে ওর বাবার বাসায়।

এর একমাসের মধ্যে হামিদ বেলার কাছ থেকে একটা উকিল নোটিশ পায়। বেলা ওর নামে ‘নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে’ মামলা করেছে। হামিদ বুঝতে পারে, বেলা সম্ভবত বিবাহ বিচ্ছেদেরও প্রস্তুতি নিচ্ছে। ওর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে।

মার্চ মাসের শেষ দিকে আদালতে মামলার প্রথম শুনানি হয়। হামিদের উকিল সেদিন আদালতে শায়ানের সাথে তার নানা সুন্দর মুহূর্তের ফটো জমা দেয়। উকিল বলে যে – হামিদ ভুল করেছে, কিন্তু ছেলের প্রতি তার মমতা প্রশ্নাতীত। উকিল একটা ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাও জমা দেয় আদালতে, যেটার মধ্যে বিস্তারিতভাবে বলা আছে হামিদ কিভাবে নিজেকে সংশোধন করবে, কিভাবে “এঙ্গার ম্যানেজমেন্টের” কোর্স করে নিজের ক্রোধ নিয়ন্ত্রণের ওপর কাজ করবে, ইত্যাদি।

এই সংশোধন পরিকল্পনাটাই সম্ভবত হামিদকে সেসময় জেল-জরিমানার হাত থেকে আপাতত বাঁচিয়ে দিয়েছিল। তবে শর্ত ছিল যে, উল্লেখযোগ্য উন্নতি না করা পর্যন্ত সে শায়ান কিংবা বেলার ত্রিসীমানায় যেতে পারবে না। আদালতের সদুপদেশে স্পষ্ট বলা হয়েছিল, একজন নামি মনোবিশারদের তত্ত্বাবধানে এক বছর পার করা আর বছর শেষে একটা পরীক্ষা দিয়ে হামিদকে প্রমান করতে হবে যে সত্যি সত্যিই তার অবস্থার উন্নতি হয়েছে।

পর্ব ১: অবচেতন মন

১.১

হামিদের মামা গিয়াস উদ্দিন চিশতী মৌলানা ঘরানার মানুষ – কাঁচা-পাকা দাড়ি তার মুখে, পাড়ার স্কুলের হেডমাস্টারদের মতো কালো চশমা পরেন। গত পনোরো বছর ধরে তাহাজ্জুদের নামাজ পড়েছেন প্রতি রাতে, সারাক্ষন ওযুর ওপর থাকেন তিনি, পাঞ্জাবির পকেটে মানিব্যাগের পাশাপাশি বহন করেন মিসওয়াক। আধ্যাত্মিক জ্ঞানে সমৃদ্ধ বহু লোকজনের সাথে তার চেনা-জানা আর উঠা-বসা আছে।

ধর্মের ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ না হলেও হামিদের ঘটনাপ্রবাহ থেকে তিনি আঁচ করে নিয়েছিলেন যে তার ভাগ্নের এই সমস্যাটার সাথে অতিপ্রাকৃত কোনো কারণ জড়িত আছে, সুতরাং তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে হামিদের এই হঠাৎ করে রেগে যাওয়ার সমস্যাটার চিকিৎসাটাও হতে হবে আধ্যাত্মিক ধরণের।

গিয়াস মামা বেশ কয়েকদিন এ নিয়ে কথা বললেন হামিদের সাথে – কখনো বাসায় এসে, কখনো বা টেলিফোনে। অনেক বোঝানো-শোনানোর পর হামিদ রাজি হল মামার কথায়, মামা তাকে বাড্ডা বাজারের কাছে এক কবিরাজের কাছে নিয়ে গেলেন।

আব্দুর রহমান শরীয়তপুরী একজন বৃদ্ধ মানুষ, বয়স প্রায় আশি – কথা বলার সময় বেশ কাশেন। শুকনো ছোট-খাটো শরীর আর সাদা দাড়িতে তাকে সাধারণ একজন মুরুব্বি ছাড়া আর কিছু মনে হল না হামিদের। কিন্তু মামা জানালেন, উনি খুবই আল্লাহওয়ালা লোক এবং মানুষের বিভিন্ন সমস্যার ব্যাপারে উনি সঠিক মারফতি সমাধান দিতে সক্ষম। কিছু খাদেম তার পা টিপছিল।

বৃদ্ধ কবিরাজ কিছুক্ষণ দোয়া-দরূদ আর ঝাড়ফুঁক করে হামিদকে জিজ্ঞেস করলেন সে কোন ভৌতিক স্বপ্ন দেখে কিনা। হামিদ বলল যে – হ্যাঁ, সে মাঝেমধ্যে এরকম দু:স্বপ্ন দেখে।

কবিরাজ ভদ্রলোক অনেকক্ষন চোখ বন্ধ করে থাকলেন। হামিদ যখন ভাবতে শুরু করেছে যে তিনি ঘুমিয়ে গেছেন, তখনি তিনি চোখ খুললেন, সরাসরি তাকালেন হামিদের চোখে, তারপর একজন খাদেমের কানে কানে কি যেন বললেন।

খাদেম জানাল – হামিদের ওপর নাকি এক পুরুষ জীনের আসর আছে। কবে এবং কোথা থেকে সেই পুরুষ জীন তার কাছে এসেছে সেটাও নাকি কবিরাজ বলে দিয়েছেন – বাইশ বছর সাত মাস সতর দিন আগে কেশবপুর নামের কোন মহল্লায় এই জীন নাকি তাকে নজর দিয়েছিল।

বৃদ্ধের প্রধান খাদেম ধরণের লোকটা তাদেরকে তাজিমের সাথে হুজুরের খাস কামরা থেকে বাইরে নিয়ে এসে আরো বললো – পুরুষ জীনগুলাই বেশির ভাগ সময় আদম সন্তানের হঠাৎ বিনা কারণে রেগে যাওয়ার সমস্যার আসল কারণ হয়ে থাকে।  

“পুরুষ জীন?” – হামিদ কপাল কুঁচকে খাদেমের দিকে তাকালো – “কিন্তু আমি তো স্বপ্নে কোন পুরুষ জীন দেখি না।”

“আপনে স্বপ্নে বার বার একটা লোকরে দেখেন না?”

“আমি বার বার একজনকেই স্বপ্নে দেখি, কিন্তু সেটা একটা লোক না, জনাব। সেটা একটা মেয়েলোক।”

“মেয়েলোক? এমন তো হওয়ার কথা না।”- খাদেম মজিদ আলম বললো – “যে খবর আনছে, সে পাক্কা খবর আনছে, এইটা একটা পুরুষ জীন।”

হয়তো তিনি ঠিক ভরসা করতে পারছিলেন না যে হামিদকে পুরুষ জীনই আসর করেছে, তাই গিয়াস মামা ফিস ফিস করে মজিদকে জিজ্ঞেস করলেন – পুরুষ-জীন যদি মানুষের ক্রোধের সমস্যার মূলে থাকে, তাহলে মেয়ে জীন মানুষের কি সমস্যা তৈরী করে।  

“পুরুষ জীন আনে কারণ ছাড়া মেজাজ খারাপ, আর মেয়ে জীন আনে কামনা-বাসনা।” – খাদেম লোকটা গম্ভীর মুখে বললো।

তবে পুরো সাক্ষাৎকারের অভিজ্ঞতাটায় হামিদ অবাকই হয়েছে – এতো বিস্তারিত বর্ণনা কবিরাজ দিতে পারবেন বলে তার ধারণা ছিল না। ফেরার পথে মামা তাকে জিজ্ঞেস করলেন, কেশবপুর নামে কোন জায়গায় সে কখনো গিয়েছিল কিনা। হামিদ প্রথমে উত্তর না দেয়াতে মামা তাকে আবারো একই প্রশ্ন করেন। তখন হামিদ বললো – হ্যাঁ, তার চাচার বাসা ছিল রাজশাহী নগরীর ওই এলাকাতে, আর মেট্রিকের পর হামিদ চাচার বাসায় থেকেই রাজশাহী সরকারি কলেজে কলাবিভাগে পড়তো। চাচার চারতলা বাসার চিলেকোঠার ঘরে তার পড়া আর ঘুমানোর সুন্দর ব্যবস্থা ছিল।

“সেটা কি বাইশ বছর আগে?” – মামা জানতে চাইলেন।

“এরকমই হবে।“ – হামিদ অন্যমনস্কভাবে বলে। কিন্তু সে মনে মনে এরমধ্যেই হিসাব করে ফেলেছে, ঠিক বাইশ বছর সাত মাস আগেই সে ওই বাসাটায় থাকা শুরু করেছিল, তারপর দুই বছর ওই এলাকায় থেকে কলেজ পার করেছিল।

মামা গম্ভীর হয়ে ছিলেন, এদিকে হামিদ কিছুতেই স্বীকার করলনা যে এটা জীনের আসর হতে পারে। সে আধুনিক মানুষ, জীন-ভূতে বিশ্বাস করার প্রশ্নই ওঠে না। কবিরাজ সাহেবকে নিয়ে সে একটু হাসাহাসিও করল, মামা তাতে আরো গম্ভীর হয়ে গেলেন।

১.২  

হামিদ অবশ্য তার সমস্যাটার ব্যাপারে চেষ্টা ছাড়া বসে থাকল না। সে তার উকিলের পরামর্শ আর আদালতের কাছে জমা দেয়া তার পরিকল্পনার কথা ভালোমতো মনে রেখেছিলো। হামিদ সেবার ডক্টর দেবেশ চন্দ্র রয়ের শরণাপন্ন হল। সেই সময়টা ডক্টর রয় ছিলেন ঢাকার সবচেয়ে নামকরা মনোচিকিৎসক। হামিদের উকিলই রয়ের খবর দিয়েছিলেন তাকে। উনার ধারণা ছিল, নামজাদা ডাক্তারের অধীনে যদি হামিদ কাজ করে, তাহলে আদালত থেকে পুত্র শায়ানের সাথে দেখা করার অনুমতি মেলা অনেক অনেক সহজ হবে হামিদের জন্য।

ডক্টর রয় দীর্ঘদেহী সনাতন ভদ্রলোক। তার হাসিমাখা মুখ দেখেই হামিদের মন অর্ধেক ভালো হয়ে যেতে চাইলো। উনার রোগী দেখার চেম্বার বেশ বড়, খোলামেলা। রোগী একটা শুভ্র সাদা সোফায় আরাম করে বসে, উনি বসেন তার পাশের সিঙ্গেল সোফায়। এসিস্টেন্ট ধোঁয়া ওঠা কাপে কফি দিয়ে যায়, আর রয় এমনভাবে কথা বলেন যেন অনেক দিনের পুরোনো কোন বন্ধুর সাথে তার দেখা হয়েছে আর তিনি তার কাছ থেকে জেনে নিচ্ছেন বন্ধুর বাসার খুঁটিনাটি সব খোঁজ-খবর।

প্রথমেই রয় জেনে নিলেন হামিদের পরিবার আর চাকরির কথা। তার স্কুল, কলেজ, ভার্সিটি, প্রিয় বন্ধু, প্রিয় খেলা, এসবও তার একসময় জানা হয়ে গেলো। কফির কাপে ধোঁয়া কমে আসতেই তিনি আরেকটু গভীরে অগ্রসর হলেন, জানতে চাইলেন তার ভয় ও স্বপ্নের কথা – “হামিদ, এমন কি কখনো হয়েছে যে আপনি প্রচন্ড ভয় পেয়েছেন?”

হামিদ কিছুক্ষন চুপ হয়ে থাকলো, যেন এ প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিলোনা সে একেবারেই, তারপর সন্দিগ্ধ কণ্ঠে বললো – “ডক্টর, আপনি এটা কেন জানতে চাচ্ছেন? আমার সমস্যা তো রাগ? আমার সমস্যা তো ভয় না।”

রয় সস্নেহ হাসি হাসলেন – “হামিদ, আপনি কি জানেন, রাগ কোথা থেকে আসে? আমাদের মস্তিষ্কে ক্রোধের উৎপত্তি কোথা থেকে হয়? শুনতে অবাক লাগবে হয়তো আপনার, কিন্তু রাগের মূল উৎস ভয়। আপনি যখন আপনার শত্রুপক্ষকে দেখে রেগে যান, এর অর্থ হলো আপনি তার থেকে কোন ক্ষতির আশংকা করছেন, মূলত তাকে ভয় করছেন, আর সেই ভয়কে রাগ দিয়ে ঢেকে দিচ্ছেন। এসবি আপনার অবচেতন মনের সাথে আপনার সচেতন মনের খেলা।”

হামিদ বুঝতে পারলো। ইতোমধ্যে ডাক্তারের সাথে তার এই সেশনটা তার ভালো লাগতে শুরু করেছে। রয়ের আন্তরিকতার কারণেই হোক, বা পরিবেশের প্রভাবেই হোক, হামিদ এই স্বনামধন্য সাইকায়াট্রিস্টের কাছে তার জীবনের এমন অনেক কাহিনী বললো, যা সে আজ পর্যন্ত এমনকি তার স্ত্রী বেলাকেও কোনোদিন বলেনি। হামিদ বললো, যখন রাজশাহীতে তার চাচার বাসায় ছাদের রুমে থাকতো, তখন একবার সে বেশ ভয় পেয়েছিলো।

“আমি তখন রাজশাহী সরকারি কলেজে পড়ি। পড়ালেখার জন্য চাচার বাসায় থাকি। সেসময় একটা মেয়েকে প্রায়ই স্বপ্নে দেখতাম।”

“একটা মেয়েকে?”

“হ্যা, ডাক্তার সাহেব, একটা মেয়েকে।”

“পরিচিত কোন মেয়ে?”

“না, ডাক্তার সাহেব, বিশ্বাস করেন, আমার পরিচিত কারো সাথে মেয়েটার মিল কোন নেই। তবে তার চেহারা আমার এখনো মনে আছে। মেয়েটা শ্যামলা, মুখ লম্বাটে, চোখ টানা টানা – বড় বড় পাপড়ি আর প্রখর দৃষ্টি সেই চোখে। মুখের দুপাশে লুকানো দুটা বাড়তি দাঁত আছে, হাসলে বোঝা যায়, কিন্তু ওটাতে যেন ওর সৌন্দর্য আরো বেড়ে গেছে।”

“আপনার দেখি সামান্য একটা স্বপ্নের সবকিছু খুঁটিনাটি মনে আছে। আপনার কি মনে হয়, কিভাবে সম্ভব হলো এটা?” – রয় হেসে বললেন।

“ডাক্তার সাহেব, তাকে মনে না রেখে উপায় কি? তাকে তো আমি রাতের পর রাত স্বপ্নে দেখেছি।”

“ইন্টারেস্টিং,” – রয় একটু সামনে ঝুকে এলেন – “পরিচিত মানুষজনকে – যেমন স্ত্রী, বান্ধবী, কাজিন, এদেরকে – মানুষ বারবার স্বপ্নে দেখে থাকে। এটা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু সম্পূর্ণ অচেনা একটা চরিত্র দিনের পর দিন আপনার স্বপ্নে এসে হানা দিচ্ছে, এটা তো বেশ অস্বাভাবিক। আচ্ছা, সে কি বলতো আপনাকে আপনার স্বপ্নে। কি করতেন আপনারা স্বপ্নের ভেতর, বলা যাবে?”

হামিদ মৃদু অস্বস্তি নিয়ে হাসলো – “স্বপ্নগুলোতে মায়াকে আমি নানা অবস্থায় পেয়েছি। একেক রাতে একেক ধরণের পরিবেশে সময় কাটত আমাদের। স্বপ্নের আবছায়ার ভেতর কখনো আমরা চলে যেতাম তেপান্তরের এক মাঠে, শূন্য সেই মাঠে শুধু আমরা দুজন থাকতাম, আর কেউ থাকতো না আশে-পাশে, হাতে হাত ধরে হাটতে থাকতাম আমরা, যেন অনন্তকাল ধরে হাটছি। কখনো মেয়েটা আমাকে উড়িয়ে নিয়ে যেত অপরিচিত গাছ-পালা ভরা একটা বাগানে, খেতে দিত অদ্ভুত কিছু ফল যা কোন মানুষ কোনোদিন চোখে দেখেনি, যার স্বাদ কখনো কোনো লোক জানে নি। কখনো আবার মেয়েটা চলে আসতো আমার চিলেকোঠার নির্জন ঘরটাতেই, মানে স্বপ্নের ভেতর বিশাল শূন্য মাঠ বা জলাশয়ের বদলে দেখতে পেতাম আমার নিজের পড়ার ঘরটাকেই – দেখতাম সে চলে এসেছে, কাঁথার ভেতর ঢুকে কাতুকুতু দিচ্ছে আমাকে, যদিও কিছুটা রোমশ লাগতো তার স্পর্শ। সে এমন সব পোশাক পড়ত – সোনালী কিংবা রুপালি রঙের – হাল-ফ্যাশনের সাথে যার কোনো মিল নেই, কিন্তু তবুও তাকে সেসব পোশাকে অপরূপ রূপসী মনে হত আমার। কখনো সে দেখা করতে আসত কোনো পোশাক ছাড়াই। আমি ওর নাম জানতাম না, স্বপ্নে ও শুধু ইশারা-ইঙ্গিতে কথা বলত – যেন সে একটা বোবা মেয়ে। জানেন, অনেক ভেবে-চিন্তে আমি তার একটা নামও দিয়েছিলাম আমি – আমি তার নাম দিয়েছিলাম ‘মায়া’। কেন যেন আমার মন বলছিলো, এটাই তার জন্য যথার্থ একটা নাম হবে।”

ডক্টর রয় হঠাৎ শিরদাঁড়া সোজা করে বসলেন – “দাঁড়ান, দাঁড়ান, আমি আপনাকে জিজ্ঞেস করেছি, আপনি জীবনে কখনো সিরিয়াস রকম ভয় পেয়েছেন কিনা। এই স্বপ্নগুলোর সাথে তো আমি ভয়ের কোন সম্পর্ক দেখতে পাচ্ছি না। একটা মেয়েকে স্বপ্নে দেখা তো রোমান্টিক বিষয়, ভয়ের কিছু নেই এতে।”

“ভয় একে নিয়ে না, ডাক্তার সাহেব, ভয় ওর সাথে যে আসতো তাকে নিয়ে।”

“ওর সাথে আসতো? স্বপ্নে?” – রয়ের ভুরু জোড়া কুঁচকে গেলো।

“হ্যা, একটা লোক আসতো ওর সাথে। সব সময় না, মাঝে মধ্যে। কিন্তু পুরুষ লোকটা যেদিন আমার স্বপ্নে আসতো ওই কমবয়সী মেয়েটার সাথে, সেদিন আমার কেন জানি না ভীষণ ভয় করতো। এত ভয় করতো যে আমি ঘুম থেকে উঠে দেখতাম আমার সারা গা ঘামে ভিজে গেছে। ওই বিশ্রী লোকটাকে যেদিন স্বপ্নে দেখতাম, তার পরের সারাটা দিন আমার খারাপ যেত। মাথায় ভীষণ ব্যথা হতো সারা দিন ধরে, আর মেজাজটাও খিচড়ে থাকতো সারাদিন।”

“পুরুষ লোকটার কথা আপনার মনে আছে? ওকে দেখলে কেন আপনার এত ভয় লাগতো? স্বপ্নে সে কি আপনাকে আঘাত করতো? মারতে আসতো?” – রয় জানতে চাইলেন।

“না, ডাক্তার সাহেব, মারতে আসতো না, ভয়ও দেখাতো না । কিন্তু তার চেহারা আর আচার-আচরণই ছিল এমন যে ওকে দেখলে আমার মনে তীব্র আতঙ্ক জেগে উঠতো। যে রাতগুলোতে এই পুরুষটা আসতো মেয়েটার সাথে, মেয়েটা কালো শাড়ির মতো একটা কাপড় পরে আসতো সেই স্বপ্নগুলোতে, আর সেই বিশ্রী লোকটা মেয়েটার সাথে গায়ে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকতো। ডাক্তার সাহেব, এইরকম বিশ্রী কোন পুরুষ মানুষ আমি জীবনে কোনোদিন দেখিনি। এজন্য আমি নিশ্চিত, বাস্তবের পরিচিত কোন মানুষকে আমি তার আকৃতিতে স্বপ্নে দেখতাম না। সত্যি ভীষণ বদখত ছিল লোকটা, ভীষণ মোটা শরীর, বয়স্ক পুরুষ, সামনের একটা দাঁত নেই, শরীরের তুলনায় বড় ঢিলে কাপড় পড়া। এই লোকটার চোখ দুটো রক্ত লাল দেখাত, আর আমার দিকে লোকটা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকত। মাছের চোখের মতো সেই দৃষ্টি, মনে হতো সে পলক ফেলতে জানে না। জানেন, সেই রাতগুলোতে মেয়েটা কিছুতেই আমার কাছে আসতে পারত না, দূর থেকে করুণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকত। মনে হতো, যেন মেয়েটা লোকটার রক্ষিতা, আর লোকটা তাকে আটকে রেখেছে। ভয়াবহ একটা অবস্থা।”

এপয়েন্টমেন্টের সময় দ্রুত শেষ হয়ে আসছিলো বলে সেদিন সেশন আর তেমনভাবে এগুলো না। কিন্তু সেই অদ্ভুত বিকেলে চেম্বার থেকে বের হয়ে এসে দিলকুশা বাণিজ্যিক এলাকার ব্যস্ত সড়কে হাটতে হাটতে কেন যেন বার বার অন্যমনস্ক হয়ে যেতে লাগলো।

১.৩

সোমবার দিনটা হামিদের শুরু হলো তীব্র হতাশা দিয়ে। উকিল ইকবাল হোসেনকে ফোন করেছিল সে। কিন্তু না, কোন আশার সংবাদ নেই। ছেলে শায়ানকে সে দেখতে পারবে না, কেননা হাকিম নড়লেও তার হুকুমগুলো নড়ে না। সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে সে ট্রিটমেন্ট শুরু করেছে, এটা আদালতের কাছে হামিদকে ছেলের কাছে যাওয়ার মতো যথেষ্ট আলামত না।

হামিদ অপেক্ষায় রইলো বিকেলের জন্য। আজ ডক্টর রয়ের সাথে তার দ্বিতীয় সেশন। সে এই চিকিৎসার ব্যাপারে এতদিনে বেশ আশাবাদী হয়ে উঠেছে। উকিল ইকবাল সাহেবকে এই আশাতেই সে ফোন করেছিল আজ সকালে, যদিও উকিল তাকে ভালো কোন সংবাদ দিতে পারে নি। তাই শায়ানের ছবির দিকে মাঝে-মধ্যে তাকিয়ে থেকেই হামিদকে সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে এই সারাটা দিন।

এই দ্বিতীয় সেশনে ডক্টর রয় হামিদের সাথে কথা চিকিৎসার পদ্ধতি নিয়ে কথা বললেন। তিনি বললেন, সব দিক ভেবে-চিন্তে তিনি হিপনোটিক সাজেশনকেই হামিদের জন্য সবচেয়ে ভালো পদ্ধতি মনে করছেন। হামিদের রাজি না হওয়ার কোন কারণ ছিল না। তখন ডক্টর রয় হামিদকে সমস্যাটির আগাগোড়া চমৎকারভাবে বুঝিয়ে বললেন।

ডক্টর রয় হামিদকে শেখালেন যে মনের দুইটা স্তর আছে – সচেতন স্তরটা আমাদের পরিচিত মন যা আমরা বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য ব্যবহার করি, অন্যদিকে অবচেতন স্তরটা আমাদের স্বাভাবিক আয়ত্ত্বের বাইরে। যেহেতু রাগ, প্রেম, ভয় এসব অবচেতন মনের বিষয়, সুতরাং হামিদের ক্রোধ কমাতে হবে অবচেতন মনের ভেতর প্রবেশ করে। আর অবচেতন মনে ঢুকে পড়ার একটি পরীক্ষিত পদ্ধতি হচ্ছে এই সম্মোহন।

বোঝানো শেষ করে ভদ্রলোক হামিদকে আরাম করে বসতে বললেন, দশ-পনর মিনিটের জন্য পৃথিবীর কথা ভুলে যেতে বললেন। উনার কণ্ঠ নরম হয়ে আসছিল। হামিদকে সম্মোহিত করে ডক্টর রয় বললেন – “এখন একটা ঘর কল্পনা করুন, শূণ্য ঘর। এ পৃথিবীতে আছেন শুধু আপনি, আর আপনার এই ঘর। এটাই আপনার মনের ঘর।”

বেশ কয়েকবার চেষ্টার পর হামিদ সেটা কল্পণা করতে পারল। একটা সাজানো-গোছানো ড্রইং রুম – মাঝখানে একটা সাদা ডাবল সোফা, একপাশে বইয়ের লাইব্রেরি, অন্যপাশে শোকেস। হামিদ তার মনের ঘর দেখে সত্যিই খুব শান্তি অনুভব করল। রয় বললেন এটা তার সচেতন মন।

ডক্টর রয় তাকে একটা সাদা রং করা দরজা খুঁজতে বললেন, হামিদ তার কল্পনার ভেতর ডানদিকে তাকিয়ে দেখল সেখানে একটা দরজা আছে। রয়ের সাজেশন অনুযায়ী দরজাটা খুলতেই সে দেখতে পেল, বরাবর একটা সিড়ি নেমে গেছে নিচে। নিচে অন্ধকার, কিন্তু সিড়ির ওপরের ধাপগুলো দেখা যাচ্ছে।

রয় তার কণ্ঠস্বর প্রায় খাদে নামিয়ে সাজেশন দিয়ে যাচ্ছিলেন – “নিচের ঘরটা অন্ধকার, কারণ ওটা আপনার অবচেতন মন। মনের এই ঘরের কাজকর্ম ঘটে আপনার অজান্তে . . . . . . ওই ঘরে কি হচ্ছে জানতে চান? তাহলে সিড়ি গুনে গুনে নেমে যান। চলুন না, ঘুরে আসি সেই ঘরে। আচ্ছা, মোমবাতিটা নিয়ে যাবেন সাথে করে, কারণ ও ঘরটা চির অন্ধকার।”

এবার রয় সাজেশন দিলেন সে যেন সিঁড়িটার ধাপ গুনে গুনে নিচের ঘরে নেমে যায়। হামিদ সেটাই করল, তীব্র কৌতূহল নিয়ে ধীরে ধীরে নামতে থাকল নিচের সে রহস্যময় ঘরটায়। এক থেকে দশ পর্যন্ত গুনতে গুনতে হামিদ দেখল সে আসলেও নতুন একটা ঘরে চলে এসেছে। এ ঘরটা ওপরের ঘরটার মতই, কিন্তু মোমের আলোয় সে দেখল এ ঘরের দেয়ালের রংটা গোলাপী।

মনের এই নিচের ঘরে হামিদ ডাক্তারের কণ্ঠ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিল। তিনি নির্দেশ দিচ্ছেন সে যেন ওই ঘরের দেয়ালে বড় বড় করে “রাগ” শব্দটা লেখে, তারপর আবার সেই শব্দটার ওপরই ক্রসচিহ্ন দিয়ে দেয়। হামিদ ঠিক ঠিক যখন সাজেশন অনুসরণ করলো, তখন রয় তাকে সিঁড়ি উল্টো গুনে গুনে উপরে উঠে আসতে বললেন। এভাবে সচেতন মনের ড্রইং রুমে উঠে আসা মাত্রই রয় তার নাম ধরে ডাকলেন আর সাথে সাথে হামিদের সম্মোহন ভেঙে গেল।

হামিদ চোখ খুলে দেখল, সে রয়ের চেম্বারের সেই আধো-অন্ধকার ঘরটাতেই বসে আছে। আশ্চর্য সুন্দর একটা অভিজ্ঞতা – হামিদ ভাবল।

“কেমন লাগল, নিজের মনের ঘর দেখতে? অবচেতন মনটা কেমন যেন রহস্যময়, তাই না?” – উৎসাহ নিয়ে জানতে চাইলেন রয়।

হামিদ মাথা নাড়ল, তারপর কি মনে হতেই তাড়াতাড়ি বলল – “আচ্ছা, অবচেতন মনের ভেতর আমি যেন একটা ছায়া দেখলাম। এটা কি, ডাক্তার সাহেব?”

“ছায়া?”

“হ্যাঁ, যেন অন্য কেউ আছে ওখানে, আমি বাদে অন্য কেউ?”

রয় ভ্রূ কুঞ্চিত করলেন – “এরকম তো হবার কথা না।”

“মানে? এরকম হবার কথা না কেন?”

“কারণ” – রয় বোঝানোর ভংগীতে বললেন – “আপনার মনের অবচেতনে আপনি ছাড়া আর কারো প্রবেশাধিকার নেই, এমনকি জেগে থাকা অবস্থায় আপনার নিজেরও সেখানে ঢোকার শক্তি থাকে না।”

“তাহলে ছায়াটা কার?”

রয় চুপ করে কি যেন ভাবলেন, তারপর বললেন – “আপনি ঠিক কি দেখেছেন সেটা জানতে হবে, অবচেতন মন রহস্যময় জায়গা তো, খুব ভালোভাবে না জেনে কিছু বলা সম্ভব না।”

হামিদ চুপচাপ কথাটা শুনল – সম্মোহনের ঘোর যেন তার পুরোপুরি কাটেনি তখনো। হামিদ সেদিনের মত চলে এলো, কিন্তু তার মনে আশ্চর্য এক স্বপ্নের মত জেগে রইল সে সন্ধ্যার কথা।

এরপর দেখতে দেখতে দুই সপ্তাহ চলে গেছে। হামিদ এরমধ্যে মজার একটা জিনিস লক্ষ্য করেছে – যখনই কোন কারণে তার রাগ ওঠে, তখনই কোথা থেকে চোখের সামনে একটা ক্রশচিহ্ন ভেসে ওঠে, আর ওমনি তার রাগ পানি হয়ে যায়।

একদিন পাঁচশ টাকার একটা নোটের ভাংতি চাইতেই এক দোকানদার তার সাথে খুব বাজে একটা প্রতিক্রিয়া দেখাল। অন্য কোন সময় হলে তার মাথায় রক্ত উঠে যেত, সেদিন সে শান্তভাবে লোকটাকে শুধু বলল – “এত কথা না বলে শুধু বলবেন – ভাংতি নেই, এতে আপনারই কষ্ট কম হবে।” নিজের ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ দেখে হামিদ সেদিন বেশ অবাকই হল।

১.৪

এরমধ্যে একদিন গিয়াস মামা এলেন হামিদের বাসায়। সেই বৃদ্ধ কবিরাজ নাকি তার কথা জানতে চেয়েছে মামার কাছে। হামিদ বলল, সে ডাক্তার দেখাচ্ছে।

“ডাক্তার দেখাও, বাবা। কিন্তু পাশাপাশি এই চিকিৎসাটাও কর, এতে ক্ষতির কিছু নেই।  

তাছাড়া পুরুষ জিনগুলা কিছুটা নাছোড় ধরণের হয়, বাবা, তাই আরো বেশি সাবধান থাকা দরকার।” – মামা বললেন।

“কিন্তু গিয়াস মামা, আমি তো বলেছি স্বপ্নে আমি কোন পুরুষ জীন দেখি না, আমি দেখি একটা মেয়েকে, সেটারও নিশ্চয়ই কোন যৌক্তিক বা বৈজ্ঞানিক কারণ আছে।” – হামিদ প্রতিবাদ করে বললো।

“জানি, তুমি এগুলি মানতে চাও না। কিন্তু এগুলি আছে, আর হুজুর সেটা জানতে পেরেছেন। শোনো, তোমার ওপর যে নজরটা পড়েছে সেটা খুব খারাপ ধরণের। খারাপ না হলে উনি আলাদা করে তোমার কথা আমাকে জিজ্ঞেস করতেন না – কত লোক আসে উনার কাছে ! তুমি এটা অবহেলা কোরো না।” – মামা মনে করিয়ে দিলেন। হামিদ মাথা নাড়ল।

“আমি এই দোয়াটা এনেছি। তুমি এটা সবসময় তোমার কাছে রাখবে। এটা কিন্তু খ্বুই গুরুত্বপূর্ণ, বুঝলে বাবা?” – গিয়াস মামা হিজিবিজি লেখা একটা কাগজ ওর দিকে এগিয়ে দিলেন।

হামিদ কাগজটা নিল, তারপর মানিব্যাগে সেটা ভরে রাখল। মামা চলে গেলেন।

১.৫

হামিদ ততদিনে শায়ানের ব্যাপারে তার উকিলকে বিরক্ত করা বাদ দিয়ে দিয়েছে। সে বুঝে ফেলেছে, আইন-আদালত সহজ জিনিস না। সে তার ছেলেকে যতই ভালোবাসুক, নিজের ক্রোধের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রমান করতে না পারলে সে কোনোদিন আর তার ছেলের সাথে দেখা করতে পারবে না। শায়ানের ছবির দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলেই দিন কাটাতে হবে তার। বরঞ্চ তার এখন উচিত নিজের মিশন অর্থাৎ সম্মোহন চিকিৎসার দিকে মন দেয়া।

সুতরাং সে তৃতীয়বারের মতো ডক্টর রায়ের চেম্বারে গেল। রয় তাকে আগের মতোই সম্মোহিত করলেন। সম্মোহনের মাধ্যমে সে তার অবচেতন মনের ঘরে ঢুকল, তখন রয় তাকে সাজেশন দিলেন যে রাগের সময় সে শান্ত থাকবে। তারপর যথানিয়মে হামিদকে তিনি বের করে আনলেন মোহাবস্থা থেকে। হামিদ একসময় সম্মোহন থেকে জেগে উঠল বাস্তবতায়।

“এভাবে আপনাকে নিয়মিত করতে হবে, যেন আপনার অবচেতনে সাজেশনটা স্থায়ী হয়ে যায়, বুঝলেন?” – রয় হাসি হাসি মুখে তার দিকে তাকালেন।

কিন্তু হামিদকে একটু অন্যমনস্ক মনে হল। সে চিন্তিত মুখে বলল – “আজও দেখেছি।”

“কি দেখেছেন আজও?”

“ছায়া, আজকে মনে হয় ছায়ার মালিককেও দেখলাম।” – হামিদ বলে।

“ছায়ার মালিক মানে?”

“সেদিন যার ছায়া দেখেছিলাম অবচেতন মনের ঘরটায়। এটা একটা মেয়ের ছায়া।”

“ইন্টারেস্টিং,” – রয় তার চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলেন – “এরকম তো শুনিনি কখনো। আপনার পরিচিত কারো সাথে মিল আছে তার চেহারার? আপনার অতীত জীবনের কোন প্রেম?”

হামিদ মেয়েটাকে চিনতে পেরেছে – এটাই সেই মায়া, যাকে সে বারবার স্বপ্নে দেখতো যৌবনে। কিন্তু সেই কথা বললেও কেউ বিশ্বাস করবে না, বরং তাকে পাগল ভাববে। তাই উত্তরে হামিদ বলল সে জীবনে এ চেহারা দেখেনি, কিন্তু সে এটাও বলল যে মেয়েটা অসম্ভব রূপসী।

রয় একটা দীর্ঘনি:শ্বাস ফেললেন – “সম্ভবত আপনার উইশফুল থিংকিং এটা, স্বপ্নের রাজকন্যা। তবে আপনাকে ফ্র্যাংকলি বলি, হিপনোটিক সাজেশনের সময় এরকম কোন স্বতন্ত্র এনকাউন্টারের কথা এই প্রথম শুনলাম আমি। এটা হবার কথাও নয় – কারণ হিপনোটিক সাজেশন দেবার সময় পেশেন্ট থাকে পুরোপুরি ডাক্তারের নিয়ন্ত্রণে, ডাক্তার যা বলে তাই তার কাছে সত্য বলে মনে হয়, অন্যকিছুর কথা সে তখন ভাবতে পারে না – পারলে সাজেশন দেয়া সম্ভব হতোনা, আর মনও সে সাজেশন নিত না।”

রয় চুপ করে বসে কি যেন ভাবছিলেন, তখন হামিদ হঠাৎ কি মনে করে বললো – “আরেকটা জিনিস ডাক্তার সাহেব। নিচের যে ঘরটা, আধো-অন্ধকার ঘরটা, যেটা কিনা আমার অবচেতন মন, সেটার নিচে কি আরো কোনো ঘর আছে? বা কোনো সুড়ঙ্গ ধরণের কিছু?”

রয় মাথা তুলে তাকালেন – “মানে?”

“আমি যখন ওই ঘরে ঢুকলাম, মেঝের নিচে আওয়াজ হচ্ছিলো। দেখলাম, মেঝেতে লাল একটা কার্পেট আর ওদিক থেকেই আওয়াজটা আসছে। কার্পেটটা সরিয়ে দেখি একটা দরজার মতো, মেঝেতে। কিন্তু ভয়ে ওটা আর আমি খুলে দেখিনি।”

“ইন্টারেস্টিং” – রয় বললেন – “কার্ল ইউং এরকম একটা ধারণা দিয়েছিলেন বহু বছর আগে। তিনি বলেছিলেন, মানুষের মনের দুটা স্তর – সচেতন মন, আর অবচেতন মন, কিন্তু সেটাই শেষ না। কিন্তু অবচেতন মনেরও নিচে আরেকটা স্তর আছে – যে স্তরে আমাদের পূর্বপুরুষদের প্রাচীন চিন্তা-ভাবনার তথ্যগুলো সব প্রবাহমান থাকে, যে স্তরে আমাদের স্বপ্ন আর আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতাগুলো জন্ম নেয়। অনেকে ধ্যানের মাধ্যমে সেই স্তরে গিয়েছে, এমনকি সেখানে নাকি একজন আরেকজনের সাথে যোগাযোগও করতে পারে – হয়তো এটাই টেলিপ্যাথির ধরণের রহস্যগুলোর আসল ব্যাখ্যা, কে জানে? একটা সম্মিলিত অবচেতন স্থান, তোমার মনের ঘরের তুলনায় এটা অনেকটা আন্ডারগ্রাউন্ড পার্কিংয়ের মতো যে পার্কিংটা অনেকগুলো ঘরের নিচে একটা উন্মুক্ত এলাকা। সে যাই হোক, ওই স্তরে যাবার স্বীকৃত কোন পদ্ধতি কিন্তু আমার জানা নেই।”

পরের মাসে হামিদ চিকিৎসার ফল আরো ভালোভাবে অনুভব করল। সে লক্ষ্য করল – শুধু যে তার রাগ কমে গেছে তাই না, সে উত্তেজিতও হচ্ছে খুব কম। অনুশীলনটা সম্ভবত তার মানসিক স্বাস্থ্যের ক্রমাগত উন্নতি ঘটাচ্ছে, ফলে সব ক্ষেত্রেই তার ভালো প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

এরমধ্যে আরেকদিন মামার সাথে তার দেখা হল। উনি জানতে চাইলেন, সে দোয়ার কাগজটা ঠিকমত রেখেছে কিনা। হামিদ বলল – হ্যাঁ, সেটা সে সাথেই রেখেছে।

মামা তার কানের কাছে মুখ নিয়ে আস্তে আস্তে করে বললেন – “শোনো, তোমার ওপর কিন্তু একটা না, অন্তত দুইটা আসর আছে – একটা জীন, আরেকটা জীন্নি। খুব সাবধান বাবা। কাগজটা অবশ্যই খুব সাবধানে রাখবে।”

“জীন তো বুঝলাম। জীন্নি মানে কি, মামা?”

“জীন্নি হলো নারী জীন, এগুলি আরো বেশি ভয়ঙ্কর।”

“একসাথে দুই জীন মানুষকে আসর করতে পারে?” 

“একসাথে একুশটা পর্যন্ত জীন মানুষকে আসর করতে পারে। যেটা জানো না, সেটা নিয়ে মস্করা করো না, বাবা হামিদ।”

মামা চলে যাবার পরে হামিদ মানিব্যাগ ঘেটে দেখল, দোয়ার কাগজটা সেখানে নেই – সম্ভবত কখনো সেটা কোথাও পড়ে গেছে। তবে হামিদকে সেটা নিয়ে খুব একটা চিন্তিত মনে হল না – সে সম্মোহন চিকিৎসার ভেতরই তার সমস্যাটার সমাধান পেয়ে গেছে। ফলে মামার কথা আর দোয়া পড়া কাগজের ব্যাপারটা সে একসময় ভুলেই গেল।

১.৬

তৃতীয় মাসে হামিদ এপয়েন্টমেন্ট অনুযায়ী ঘড়ি ধরে কাটায় কাটায় ঠিক সময়ে রয় সাহেবের চেম্বারে গিয়ে উপস্থিত হল হিপনোটিক সাজেশন নেবার জন্য। শুরু হলো তৃতীয় সেশনের সম্মোহন পর্ব।

মোহাচ্ছন্ন একটা অবস্থায় পৌঁছে যাবার পর সে তার মনের ঘরে ঢুকল, ঢুকে ডানদিকে দরজা দেখল। সে দরজা খুলে সিড়ি বেয়ে সহজেই নেমে গেল মাটির নিচের ঘরটায়, অর্থাৎ তার অবচেতন মনে। মোমের আলোয় সে স্পষ্ট দেখতে পেল ঘরের বিভিন্ন অংশ, বিশেষ করে সেই দেয়ালটা যেখানে রাগ কথাটা লিখে তার ওপর ক্রশচিহ্ন দিয়েছিল সে নিজে। সে দিন দিন অভ্যস্ত হয়ে উঠছে সম্মোহনের ব্যাপারটায়, ফলে এসব ঘটল খুব সহজে আর খুব দ্রুত। সবশেষে সে ঘরের মাঝখানে গিয়ে বসল, সেখানে সে অপেক্ষা করতে থাকল রয়ের সাজেশনের জন্য।

ঠিক তখনই ঘটল ঘটনাটা। সে মেয়েটাকে আবার দেখতে পেল – ওর ছেলেবেলার স্বপ্নের সেই মায়া। অনিন্দ্যসুন্দর একটা মেয়ে – হামিদ ভাবলো। মেয়েটা তার দিকে তাকিয়ে হাসল – নি:শব্দ হাসি। আজও মেয়েটাকে তার কাছে পরীর মত সুন্দর মনে হল। হামিদের মনে হল যেন অনেকদিন পর হারিয়ে যাওয়া কোনো বান্ধবীকে ফিরে পেয়েছে সে। সেও মেয়েটার দিকে তাকিয়ে হাসল।

এরমধ্যে সে শুনতে পেল রয়ের কণ্ঠস্বর – “উত্তেজনার সময় শান্ত থাকব, আকাশের মত শান্ত।”

তখন মেয়েটা তাকে কাছে ডাকল, সে সম্মোহিতের মত এগিয়ে গেল। মেয়েটা দেয়ালে কি যেন লিখছে। রয়ের কণ্ঠস্বর তখনও দুর্বলভাবে তার কানে আসছে – যেন ওপর তলায় বসে রয় তাকে কথাগুলো বলছেন, আর এখানে সে শব্দগুলো ঠিকমত পৌছাচ্ছে না।

হামিদ দেয়ালের লেখাটা পড়তে শুরু করল, যেটা সেই মেয়েটা এইমাত্র লিখেছে ওর জন্য – “আমাকে তুমি সারাজীবন ভালোবাসবে, তুমি আমার সাথে থাকবে চিরদিন।”

লেখাটা পড়ে কেন যেন খুব ভালো লাগলো হামিদের – উত্তেজনাভরা একটা আনন্দ।

মেয়েটা তার হাত স্পর্শ করল, হামিদের তখন ভীষণ ভালো লাগল। অসাধারণ একটা অনুভূতি। মেয়েটা এবার ওকে টেনে নিয়ে চলল। হামিদ দেখল, মেয়েটা তাকে নিয়ে যাচ্ছে প্রথমে সিড়িটার দিকে, যে সিড়ি দিয়ে সে এঘরে নেমে এসেছে। তারপরই ওরা সিড়ি বেয়ে উঠে গেল দরজাটার দিকে, যে দরজা খুলে হামিদ এ ঘরে ঢুকেছিল।

মেয়েটা ওর হাতে একটা বড় তালা এগিয়ে দিল। তারপর একবার ইংগিত করল দরজাটার দিকে, আরেকবার দেয়ালের লেখাটার দিকে।

হামিদের হৃৎপিণ্ড তখন অচেনা এক উত্তেজনায় রীতিমতো লাফাচ্ছে। মেয়েটা যখন আপনজনের মতো করে জড়িয়ে ধরলো হামিদকে আর ওর ঠোঁটে গাঢ় করে একটা চুমু খেল, রয়ের কণ্ঠ হামিদ তখন বলতে গেলে শুনতেই পাচ্ছে না।

হামিদ দরজাটা বন্ধ করে দিল – এপাশ থেকে। তারপর মেয়েটার হাত থেকে তালাটা নিয়ে লাগিয়ে দিল দরজায়।

১.৭

রয় আবারো ডাকলেন – “হামিদ, আপনি এখন জেগে উঠবেন।”

কিন্তু এবারো কোন সাড়া-শব্দ পাওয়া গেল না হামিদের মধ্যে। রয় কপালের ঘাম মুছলেন – এরকম ঘটনা তার চিকিৎসক জীবনে আর কোনদিন ঘটেনি, অন্য কারো ক্ষেত্রে ঘটেছে বলেও তার জানা নেই।

রয় আবার চেষ্টা শুরু করলেন। প্রায় আধঘন্টা ডাকাডাকির পর হামিদের চোখ খুলল। রয় হেসে স্বস্তির নি:শ্বাস ফেললেন – অবশ্য সাথে সাথে এও লক্ষ্য করলেন, হামিদের চোখ ভীষণ লাল হয়ে আছে – জ্বরগ্রস্থ মানুষের চোখের মত লাল।

“হামিদ, আপনার এখন কেমন লাগছে?” – রয় দুর্বলভাবে প্রশ্ন করলেন।

“হামিদ?” – সম্পূর্ণ অপরিচিত আর কর্কশ একটা কণ্ঠস্বর বলে উঠল – “হামিদটা আবার কে?”

পর্ব ২: অচেতন মনগুলো

২.১

হামিদের জীবনে এতো মজার সময় আর কখনো আসে নি। নিজের মনের মধ্যে পালিয়ে গিয়ে যে এত ভালো থাকা যায়, তার কোন ধারণাই হামিদের ছিল না। যারা ড্রাগ নিয়ে নেশা করে, তারা তাহলে এভাবেই একটা ঘোরের ভেতর সুখের স্বপ্নে ডুবে থাকে – কখনো জেগে উঠতে চায় না !

গোলাপি রঙের এই ঘরটার সবগুলো দেয়াল মায়া নামের মেয়েটা ভরে দিয়েছে নগ্ন-অর্ধনগ্ন সব মেয়েদের ফুল সাইজ ছবি দিয়ে। ছবিগুলোকে কেন যেন চেনা চেনা মনে হয় হামিদের, যেন তার স্মৃতি থেকে উঠে আসা ছবি এগুলো। কৈশোরে সে শিবলী ভাইয়ের বাসা থেকে পর্নো ম্যাগাজিন চুরি করে এনে সারারাত বসে বসে অশ্লীল ছবিগুলো দেখতো – হতেও পারে সেই ছবিগুলোর সাথে এই পোস্টারগুলোর মিল আছে।

মায়া নামের সেই মেয়েটা সারাদিন তার সাথে সাথে থাকে, হামিদ যা বলে সব করার চেষ্টা করে। ওর বার বার মনে হয়েছে বেহেশতে হুরপরীরা বোধহয় এরকমই হয়। হামিদ অবশ্য বেহেশতে যাওয়ার আশা করে না। কিন্তু এখানে সে খারাপ কি আছে? আর তাছাড়া সে তো জোর করে কারো সাথে কিছু করছে না। আর সবচেয়ে বড় কথা, এটা মনের ঘর – এখানে যা সে করছে তা তো শেষ পর্যন্ত তার কল্পনাই। কল্পনার মধ্যে পাপই কি আর পুণ্যই বা কি ! মানুষ তার কাজকে নিয়ন্ত্রণ করবে, কল্পনাকে কখনোই না – সুতরাং কল্পনার এই গোলকধাঁধার মধ্যে হামিদ তার যা যা চাহিদা সব মিটিয়ে নিতে চায় – সেটা সুন্দর হোক, কি অসুন্দর – এ ঘরের সেই তো রাজা!

কিন্তু একটাই সমস্যা এখানে, আর তা হল – সে এখান থেকে বের হতে পারছে না, সে অর্থে সে একজন বন্দী রাজা। আর এর মানে হলো, হামিদ জানে না কবে আবার শায়ানকে সে দেখতে পাবে। কি নিয়তি! যে শায়ানকে পাওয়ার জন্য তার এই মনোচিকিৎসা, সেই সম্মোহনের জন্যই সে আটকে পড়লো এই অবচেতনের ঘরে চিরদিনের জন্য।

ফলে একদিন – যদিও দিন-রাতের হিসাব রাখা কঠিন ছিল তার জন্য – মায়া যখন এসে ওর পাশে বসল, হামিদ আস্তে করে ওকে সরিয়ে দিয়ে বলল – “আমাকে বাইরে যেতে দাও, আমি আমার ছেলেকে একটু দেখে আসি। প্রতি বুধবার আমি ওকে স্কাইপ করি।“

মেয়েটা ওপরের দরজার তালাটার দিকে আঙ্গুল তুলে দেখাল। হামিদ বলল – “আমি তো তোমার কাছে ফিরে আসবোই, তুমি তো আমার সবকিছু।

“ কিন্তু উত্তরে মেয়েটা ক্রমাগত মাথা নাড়াতে থাকল। হামিদ বুঝতে পারল, কিছুতেই এখান থেকে ওকে মেয়েটা বের হতে দেবে না। এ কি পাগলামির মধ্যে পড়া গেল !

সুতরাং এরপর মায়া যখন ওর পাশে এসে বসল, তখন হামিদ ওকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দিয়ে সিঁড়িটার দিকে ছুটতে শুরু করল। এলবামটা দেখার পর থেকে ওর মনে হচ্ছিল, শায়ানকে একবার দেখতে না পারলে সে মরেই যাবে। ও ভাবছিলো, একবার তালা ভেঙে ওপরের ঘরে যেতে পারার অর্থ হলো সে পৌঁছে গেছে তার সচেতন মনে – তখন সে খুব সহজেই ডক্টর রয়ের সাহায্য নিয়ে এই সম্মোহন থেকে বের হয়ে আসতে পারবে। ওপরে উঠে হামিদ দরজাটা ধরাম করে খুলে দিয়ে প্রায় ছুটে বের হয়ে এলো ওপরের সে ঘরটায়, ওর পেছন পেছন মায়াও বের হয়ে এলো ধীর পদক্ষেপে। কিন্তু ওপরের ঘরে এসে সে যা দেখলো তার জন্য হামিদ একেবারেই প্রস্তুত ছিল না।

সে তীব্র আতঙ্ক নিয়ে দেখলো, বিশ্রী মোটা একটা লোক দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে, যেন ওরই অপেক্ষায়।

হামিদের আতঙ্কের কারণটা ছিল খুবই স্পষ্ট – এটা সেই লোক, যাকে সে স্বপ্নে দেখতো। এটা সেই বিশ্রী লোক, যে মায়ার সাথে জোট বেঁধে মাঝে-মধ্যে তার স্বপ্নে আসতো, আর তাকে তীব্র ভয় দেখাতো।

হামিদ বুঝতে পারলো – একটা মাত্র স্বত্বা তার মনের দখল নেয়নি, বরং তার মনের ভেতর বাসা বেঁধেছে একাধিক অন্ধকার শক্তি।

হামিদের মনে পড়লো গিয়াস মামার সাবধানবাণী। তিনি বহুদিন আগেই বলেছিলেন, হামিদের ওপর একটা না, অন্তত দুইটা আসর আছে। তাহলে কি এই মেয়েটা আর এই লোকটাই সেই দুই জীন যারা আসর করেছে তাকে একসাথে – আর এদের একজন হলো জীন, আরেকজন পরী? আশ্চর্য, সেই বৃদ্ধ কবিরাজই বা কি করে জানলেন এতসব কথা!

এসব মিলিয়ে লোকটাকে দেখামাত্র আবার তীব্র একটা ভয় আচ্ছন্ন করে ফেলল হামিদকে, আর এই সুযোগে লোকটা হঠাৎ এসে তাকে চেপে ধরলো, ধাক্কাতে ধাক্কাতে নিয়ে গেল দরজার কাছে, তারপর এক ধাক্কায় তাকে ফেলে দিল নিচের ঘরে।

ঘরের মেঝেতে পড়ে থেকে হামিদ বুঝতে পারল, ওর পরিকল্পনা পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। ওপরে তখন লোকটার চিৎকার, মারামারির শব্দ আর মেয়েটার কান্নার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিল।

২.২

ভাগ্নে বৌ বেলার ফোন পাবার পর গিয়াস মামা আর এক মিনিটও অপেক্ষা করেন নি, রাত এগারোটায় ছুটে গেছেন বৃদ্ধ কবিরাজ আব্দুর রহমান সাহেবের কুটিরে।

তার দাঁড়িয়ে থাকা দেখে একজন খাদেম তাকে আমন্ত্রণ করল একসাথে তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ার জন্য। ওযু শেষ করে যখন গিয়াস সাহেব নামাজের জন্য অপেক্ষা করছিলেন, তখন সেই খাদেম লোকটা আবার কাছে এলো। তার নাম মজিদ, সে বলল – তারা হামিদের এই সম্ভাব্য বিপদের কথা অনেকদিন ধরেই জানে। খন্নাস আর খন্নাসির এরকম জোড়া প্রায়ই খুঁজে পাওয়া যায় শহর আর গ্রামের আনাচে কানাচে, এদের কাজই হল জোড় বেঁধে শিকার ধরা – চুপচাপ ধরণের ছেলে খুঁজে পেলেই খন্নাসি মেয়েটা ফুসলিয়ে-ফাসলিয়ে তার সাথে ভাব করে, তার মনে বাসা বাধে, তারপর খন্নাসির হাত ধরে মনের মধ্যে ঢুকে যায় পুরুষ খন্নাসটা। গ্রামদেশে এটাকে জিনে ধরা বলে, কিন্তু মূল ঘটনা অতটা সরল নয়।

যদি হামিদ সজাগ থাকতো, তাহলে তারা ঝড়-ফুক করে এই ‘বদমাইশদের’ দূর করতে পারতেন – এরচেয়ে অনেক ‘জটিল কেস’ তারা অতীতে সমাধান করেছেন। কিন্তু হামিদের ক্ষেত্রে সমস্যা হল, সে সম্মোহিত অবস্থায় আছে। এটা অনেকটা জাদুগ্রস্ত হয়ে থাকার মত – এ অবস্থায় কোন স্বাভাবিক চিকিৎসা পদ্ধতি কাজ করে না। হামিদকে প্রথমে সম্মোহনের এই ঘোরের মধ্য থেকে বের হয়ে আসতে হবে, তারপরই কেবল এনারা তাকে সাহায্য করতে পারবেন।

“কিন্তু ডাক্তার তো তাকে ঘোর থেকে জাগাতে পারছে না।” – মামা বললেন।

“তাইলে হামিদ সাহেবরেই বাইরে আসার উপায় খুঁজে বাইর করতে হবে।” – খাদেম উপসংহার টানল।

সে রাতে বৃদ্ধ আবদুর রহমানের সাথে সাথে গিয়াস মামা দীর্ঘ সময় তাহাজ্জুদের নামাজ পড়লেন। নামাজ শেষে ভাগ্নের জন্য প্রাণ খুলে দোয়াও করলেন তিনি। এরপর যখন চলে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তখন বৃদ্ধ অলি তাকে কাছে ডাকলেন। কাছে গিয়ে বসতেই তিনি তার কাঁধে স্নেহভরে হাত রাখলেন, আশ্বাস দিয়ে বললেন – হামিদ যেখানে আটকে পড়েছে, সেখানে বাইরের কোন কথা পৌঁছায় না, একটা জিনিস ছাড়া, আর সেই জিনিসটা হলো দোয়া।

বৃদ্ধ নিচু গলায় বুঝিয়ে বললেন – বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন, স্ত্রী-সন্তানের দোয়ার শক্তি অনেক বেশি, সব বাধা পেরিয়ে খোদার কুদরতে ওগুলো বিপদগ্রস্তের কাছে পৌঁছে যায়। সুতরাং হামিদের নিকটাত্মীয়রা যেন তার জন্য কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করে।

গিয়াস সাহেব কথাগুলো মনে রাখার ওয়াদা করে মসজিদ থেকে বেরিয়ে এলেন।

২.৩

ডক্টর রয় ভাবতে পারেন নি, হামিদের স্ত্রী তার সাথে দেখা করতে আসবে। কাল সে বলেছিল – কোনোদিন ওকে দেখতে আসবে না, আর এই শাস্তিগুলো আসলে হামিদের প্রাপ্য।

সারা রাত রয় কাটিয়েছেন চেম্বারে, সকাল থেকে মাথা ব্যথা করছে ভীষণ। তবু তিনি বেলাকে শুভেচ্ছা জানিয়ে হামিদের রুমে নিয়ে এলেন। হামিদকে দেখামাত্র বেলা মুখে হাত দিয়ে চোখ সরিয়ে ফেলল, তারপর রয়ের দিকে তাকিয়ে বলল – “ডক্টর, আপনি ওকে জাগিয়ে তুলছেন না কেন?”

“আমি চেষ্টা করছি। গত চৌদ্দটা ঘন্টা ধরে ডেকে চলেছি, কিন্তু ও সাড়া দিচ্ছে না। মনে হচ্ছে কোনভাবে ও ওর অবচেতন মনের ঘরে আটকে পড়েছে – বের হতে পারছে না, আমার সাজেশনও শুনতে পাচ্ছে না।”

“আপনার সাজেশন ছাড়া ও নিজে নিজে বের হতে পারবে না?”

ডক্টর রয় কিছুক্ষন বেলার দিকে তাকিয়ে থাকলেন – “পারবে, যদি ও ওই ঘর থেকে বের হওয়ার অন্য কোন দরজা খুঁজে বের করতে পারে। কিন্তু ও যদি আমার সাজেশন দেয়া দরজার দিকে তাকিয়ে থাকে, তাহলে হয়তো ওখান থেকে আর কোনদিন বের হতে পারবে না।”

“আপনার সাজেশন দেয়া দরজা ছাড়া আরো দরজা আছে ওখানে?”

“অবশ্যই আছে। এটা ওর মন, ও চাইলে এমনকি নিজেকে নিজে সাজেশন দিয়ে দরজা বানিয়েও নিতে পারে। আহা, ওকে যদি শিখাতাম কিভাবে নিজেকে নিজে সাজেশন দিতে হয় !”

বেলা রয়ের দিকে নির্বাক তাকিয়ে রইল, ওর অজান্তেই ওর বা চোখ বেয়ে এক ফোটা পানি নেমে এলো।

রয় হঠাৎ সোজা হয়ে বসলেন, যেন তার কিছু একটা মনে পড়েছে। তিনি প্রায় ছুটে গিয়ে তার বইয়ের তাকে কি যেন একটা খুঁজতে লাগলেন। প্রায় মিনিট পাঁচেক খোঁজার পর খয়েরি রঙের একটা পুরোনো জীর্ণ বই বের করলেন।

“একটা উপায় থাকতে পারে।” – তাকে বেশ উত্তেজিত মনে হচ্ছিলো। বেলা চোখ মুছে তার দিকে তাকালো।

“মানুষের সচেতন মনের ঘরের নিচে অবচেতন মনের যে অন্ধকার ঘরটা আছে, এরও নিচে আছে একটা সম্মিলিত অবচেতন এলাকা, খুবই রহস্যময় এর কর্মকান্ড। সে যদি কোনোভাবে ওই জায়গাটার সন্ধান পেতো, তাহলে হয়তো ওর জন্য কোন মেসেজ ওখানে রেখে আসতে পারতাম।”

রয় বললেন, তিনি এখন ধ্যানে বসবেন – একধরণের গভীর আত্মসম্মোহন, চেষ্টা করবেন কোনোভাবে সে গভীরতর চেতনার স্তরে পৌঁছে হামিদকে খুঁজে বের করতে। তিনি অবশ্য কোন নিশ্চয়তা দিতে পারলেন না, বললেন – সেই এলাকা সম্পর্কে তার ধারণা খুবই অল্প, তবু তিনি তার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন। বেলা তাকে বিদায় জানিয়ে চেম্বার থেকে বের হয়ে এলো।

২.৪

বেশ কয়েক ঘন্টা, বা কয়েক দিন, ধরে হামিদ নিচের ঘরে বন্দি। মায়া এখন আর ওর কাছে আসে না। ওই লোক তাহলে জানতো না যে মায়া তার সাথে প্রেম করতো। সে মেয়েটাকে রেখেছিল নিচের ঘরে ওকে পাহারা দেয়ার জন্য, আর নিজে নিয়ন্ত্রণ নিতে চেয়েছিল মনের ওপরের ঘরের। মায়া তাহলে তার মালিকের, বা স্বামীর, বা যাই হোক না কেন তার, সাথে এক অর্থে বিশ্বাসভঙ্গই করেছিল।

একসময় বিরক্তি কাটানোর জন্য হামিদ তার অবচেতন ঘরের ভেতর আবার পায়চারি শুরু করল।

তখন হঠাৎ ওর মনে পড়লো, বৃদ্ধ কবিরাজের কণ্ঠ সে শুনতে পেরেছিলো এ ঘর থেকে। সে দেয়ালের বিভিন্ন জায়গা কাছ থেকে দেখে বুঝতে চেষ্টা করলো কোথাও লুকানো কোনো প্রকোষ্ঠ আছে কিনা। কিন্তু অনেক খুঁজেও তেমন কিছু পেলোনা।

তখন হঠাৎ ফ্লোরের ওপর লাল গালিচাটা ওর চোখে পড়লো, আর বুকের ভেতর কেন যেন রক্ত ছলাৎ করে উঠলো। সে দ্রুত এগিয়ে গিয়ে কার্পেটটা সরিয়ে দিলো, আর তখনি দেখতে পেলো একটা লুকোনো দরজা। এক ঝটকায় সে দরজাটা খুলে ফেললো, আর আবছা আলোতে দেখলো নিচে চলে গেছে একটা কাঠের সিঁড়ি – যতদূর চোখ যায় ততদূর, যেন ওটা অতল কোনো গহ্বরে নেমে গেছে।

হামিদ সেই সিঁড়ি বেয়ে নামতে শুরু করলো। তার ভীষণ ভয় লাগছিলো, কিন্তু সে জানতো তাকে এর শেষ দেখতেই হবে। ফলে সে নামতে থাকলো যতক্ষণ না সমস্ত আলো শেষ হয়ে যায়, যতক্ষণ না অন্ধকার নিকষ কালো কালি হয়ে চারিদিক থেকে ওকে ঘিরে ধরে।

সে জানে না, কতক্ষন সে এভাবে নেমেছে। যখন ওর মনে হতে শুরু করেছে যে সে স্থান-কাল বিহীন শূন্যতার একটা বৃত্তে ঝুলে আছে, তখন যেন নিচে আলোর একটা বিন্দু দেখতে পেলো। আরো নেমে যাবার পর সে একসময় দেখলো সিঁড়িটা শেষ হয়েছে বিশাল এক প্রান্তরে। আর সে প্রান্তরে এদিক ওদিক কিছু মানুষ দেখা যাচ্ছে। সে ছুটে গেলো কাছাকাছি একজনের কাছে, সার্কাসের জোকারের পোশাক পরে লোকটা মাটিতে খামোখাই হুটোপুটি খাচ্ছে।    

আরেকটু সামনে গিয়ে একজন মহিলাকে দেখে হামিদ তার পিছু নিলো। মহিলা তার দিকে ঘুরে তাকাতেই হামিদের ভিরমি খাবার অবস্থা, কারণ মহিলার চেহারা হুবহু হামিদের মতো – যেন ওর যমজ কোনো বোন যে কিনা ছোটবেলায় হারিয়ে গিয়েছিলো।

ভয় পেয়ে হামিদ ফিরতে শুরু করলো সিঁড়ির দিকে – এখানে একবার হারিয়ে গেলে আর কোনোদিন ফিরতে পারবে না বাস্তবের জগতে। কিন্তু তখনই সে আবার দেখলো তার নিজের ছায়া তার শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে দূরে সরে সরে যাচ্ছে। হামিদ এসবের মাথা-মুন্ডু কিছুই বুঝতে পারলো না, সে সিঁড়ির দিকে দৌড়াতে শুরু করলো – আগে ঘরে ফিরতে হবে, তারপর এসব নিয়ে চিন্তা করা যাবে।

সে যখন কাঠের সিঁড়ির খুব কাছে চলে এসেছে, হঠাৎ যেন শূন্য থেকে এক বৃদ্ধের উদয় হলো। বৃদ্ধের চুল-দাড়ি তুষারের মতো শুভ্র, চোখে কাঠের এক প্রাচীন চশমা, গায়ে জরিদার সোনালী পাঞ্জাবি, মাথায় কালো পাগড়ি। সে বিড় বিড় করে কি যেন বলছে আর চশমার আড়াল থেকে হামিদের দিকেই একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সে বৃদ্ধের হাত দুটো ধরে বললো – “আপনি কে? আপনি কি পারবেন এখন থেকে আমাকে উদ্ধার করতে?” বৃদ্ধ কিছুক্ষন অপলক চেয়ে রইলেন হামিদের চোখের দিকে, তারপর ক্ষীণকণ্ঠে বললেন – “বাবা, আপনে ওই মেয়েছেলেটাকে ছেড়ে দেন, তাহলে ওই বদলোকটা থেকে মুক্তি পাবেন।” হামিদ বৃদ্ধের হাত আঁকড়ে ধরতে চাইলো, কিন্তু বৃদ্ধ তার হাতে একটা মুখোশ ধরিয়ে দিয়ে দ্রুত হেটে একপাশে চলে গেলেন।

হামিদ মুখোশটা হাতে নিয়ে দেখলো, এটা গিয়াস মামার চেহারা চেহারা। ঠিক তখন মুখোশটা কথা বলতে শুরু করলো – “হামিদ, তুই কেমন আছিস?” আর হামিদ ভয় পেয়ে ওটা ফেলে দিয়ে সিঁড়ির দিকে দৌড়াতে শুরু করলো।

সিঁড়ি বেয়ে উঠতে শুরু করার পর চরম অন্ধকার অংশটা পার হওয়ার সময় হঠাৎ হামিদ শুনতে পেলো একটা কণ্ঠ, যেন অনেক দূর থেকে কেউ তাকে ডেকে বলছে – “ঘর থেকে বের হওয়ার আরো দরজা আছে, আরো দরজা আছে।”

হামিদ চমকে উঠলো, কারণ এই কণ্ঠটা আবার ডক্টর রয়ের। কিন্তু হামিদ আর দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পড়তে চায় না, তাই ওই কণ্ঠ অগ্রাহ্য করে দ্রুত ওপরে উঠতে শুরু করলো।

অবচেতন মনের বন্দী ঘরে ফিরে হামিদ গোপন দরজাটা বন্ধ করে কার্পেটটা টেনে দিলো ওটার ওপর। সে ভাবতে চেষ্টা করলো এই মাত্র সে কি দেখে আসলো। অনেকক্ষণ চিন্তা করেও যখন সে কোনো কুল-কিনারা করতে পারলো না, সে হাল ছেড়ে দিয়ে মেঝেতে বসে পড়লো। সেসময় আরো একটা বারের জন্য ওর চোখে পড়ল অসংখ্য নগ্ন ছবি আর পোস্টার, যেগুলো মায়া এ ঘরে লাগিয়ে রেখেছে। ওগুলোর প্রতি কেন যেন হামিদ আজ আর আগ্রহ বোধ করছে না, শায়ানের ছবি দেখার পর ওর ভেতর কি যেন একটা পরিবর্তন এসেছে – এসব কিছুই আর আগের মতো ভালো লাগে না।

এই মেয়েগুলো – যাদের ছবি এখানে টাঙানো আছে – এরা নিশ্চয়ই কারো মেয়ে কিংবা কারো বোন। যেহেতু ছবিগুলো অনেক পুরোনো, হয়তো এই মেয়েগুলো এতদিনে বয়স্ক মহিলাও হয়ে গেছে, কেউ কেউ মা হয়েছে। তাহলে এই ছবিগুলোর কি অর্থ? কেন এগুলো এখানে রাখতে হবে?

হামিদ কিছু না ভেবেই ছবিগুলো নামিয়ে ফেলতে শুরু করল। খুলতে গিয়ে অনেকগুলো পোস্টার ছিড়েও গেল। সবগুলো ছবি খুলে ফেলার পর সে যখন ওর শোওয়ার জায়গাটায় ফিরে এলো আর শূন্য দেয়ালগুলোর দিকে তাকাল, তখন অবাক হয়ে দেখতে পেল প্রতিটা বড় পোস্টারের জায়গায় একটা করে ফাঁকা জায়গা। সে অবাক হয়ে সেগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকল, দেয়ালের মধ্যে পোস্টারের পেছনে এই খোলা জায়গাগুলো কি সবসময়ই ছিল তাহলে? সে এতদিন শুধু এগুলো লক্ষ্য করে নি?

হামিদের মনে পড়লো, এই একটু আগেই রহস্যময় সে প্রান্তরে আরো রহস্যময় সেই বৃদ্ধ ডক্টর রয়ের কণ্ঠ নিয়ে তাকে বলেছিলো যে ঘরে থেকে বের হওয়ার আরো দরজা আছে। এটা কি সেরকমই একটা দরজা?   

হামিদ জানে, এটা ওর মন, এখানে অনেক বিচিত্র জিনিস ঘটতে পারে। তাই সে দেয়ালের একটা বড় ফোকরের দিকে এগিয়ে গেল। ওর মনে হল এর ভেতর একটা মানুষসমান বড় পাইপের মতো পথ আছে। সে একটু ঝুকে ওটার ভেতর ঢুকে হামাগুড়ি দিয়ে এগুতে শুরু করল।

একটু চলার পরই ওর মনে হল কোথা থেকে যেন আলোর একটা রেখা আসছে। সে সেই আলো অনুসরণ করে এগিয়ে চলল, আর ঠিক তখনই শুনতে পেল পরিচিত কিন্তু ক্লান্ত একটা কণ্ঠস্বর – “হামিদ, প্লিজ আপনি জেগে উঠুন।”

পরিশিষ্ট

সেদিন বেলা আর ডক্টর রয়ের চোখের সামনেই হামিদ জেগে উঠে জিজ্ঞেস করেছিল সে কোথায়। কি মনে করে রয় তাড়াতাড়ি জানতে চেয়েছিলেন সে হামিদই কিনা, সে হ্যা বলে প্রায় সাথে সাথেই আবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল। কাছাকাছি এক হাসপাতালে প্রায় তিনদিন শুশ্রুষার পর হামিদ কিছুটা সুস্থ হয়ে ওঠে।

সে ঘটনার এক সপ্তাহের মধ্যে হামিদকে গিয়াস মামা নিয়ে গিয়েছিলেন সেই বৃদ্ধ কবিরাজের কাছে, তারপর তাকে সেখানে রেখে চলে এসেছিলেন। আবদুর রহমান সাহেবের কাছে চল্লিশ দিন চল্লিশ রাত কাটিয়ে সেবার আধ্যাত্মিকভাবে পুরোপুরি সুস্থ হয়েই তবে বাসায় ফিরেছিল হামিদ। আব্দুর রহমান সাহেব গ্যারান্টি দিয়ে বলেছিলেন, চল্লিশ দিনের এই ট্রেনিং কোন শয়তান কোনদিন ভুলিয়ে দিতে পারবে না। শত হলেও চল্লিশের একটা আলাদা হেকমত আছে – ইউনুস নবী চল্লিশ দিন মাছের পেটে ছিলেন, মুসা নবী চল্লিশ দিন তুর পাহাড়ে খোদার ধ্যানে মগ্ন ছিলেন তার নবুওত পাওয়ার আগে।

বেলাও হামিদের কাছে ফেরত এসেছিল। সে যখন বুঝতে পেরেছিল যে তার স্বামী শুধু একটা মোহগ্রস্ত অবস্থায়ই ওসব কান্ড ঘটাতো, তখন তাকে ক্ষমা করা বেলার জন্য সহজ হয়ে গিয়েছিল। শায়ানকে ফিরে পেয়ে হামিদও যার পর নাই সুখী হয়েছিল আর প্রতিজ্ঞা করেছিল যে জীবনে সে আর কোনদিন কোন কাম বা ক্রোধের ফাঁদে পা দেবে না, সকাল-বিকেল নামাজ পড়ে খোদার কাছে পানাহ চাইবে শয়তানের হাত থেকে বাঁচার জন্য।

অবশ্য কোন কোন নির্জন সন্ধ্যায় শেষ সূর্যের কোমল আলো পড়ে যখন পশ্চিম আকাশের মেঘগুলো গোলাপি রং ছড়িয়ে দিতো চারিদিকে, তখন হামিদের মনে পড়ে যেত মায়া নামের সেই মেয়েটার কথা – সব সময় না, কখনো কখনো। মেয়েটা এখন কোথায় কিভাবে আছে কে জানে ! ওর কেন যেন বিশ্বাস হতে চাইতো যে সেই অশরীরী তাকে সত্যি সত্যিই ভালোবাসতো। কে বলতে পারে, হয়তো মায়া ছিল ওই নিষ্ঠুর পুরুষ জীনটার শয়তানি খপ্পরে বন্দি, তাই বাধ্য হয়েছিল হামিদকে ফাঁদে ফেলতে, কিন্তু আসলে মেয়েটা এমনিতে হয় তো খারাপ কেউ ছিল না। হতেও তো পারে, তাই না ! পৃথিবীটা আসলে বিচিত্র এক জায়গা। ব্যাখ্যাযোগ্য এবং ব্যাখ্যার অতীত অনেক ঘটনাই এখানে ঘটে। আর তাছাড়া কেউ যখন জীবন থেকে হারিয়ে যায়, তখন সে পরী ছিল না যাদুকরী শক্তিধর ডাইনী ছিল তাতে কিছুই আসে যায় না। অতীত অতীতই, যা গেছে তা আর ফিরে আসবে না। বরং একদিন আমাদের চারদিকে সবকিছু বদলে যাবে, সেদিন আমরা হয়তো আমাদের অতীত অনুভূতিগুলোকে অন্যভাবে দেখতে শিখব। আর বুঝতে পারব, কতগুলো সত্যকে তলিয়ে না দেখাই ভালো।

One thought on “ছায়া কিংবা পরীর গল্প

  1. ২০১৫/১৬ তে এই গল্পটা তাও অপূর্ণ অংশ টুক পড়েছিলাম। এত বছর ধরে এই গল্পটা আমার মাথায় গেঁথে ছিলো। আজ হঠাৎ কেন জানিনা সার্চ করলাম, যদি পাওয়া যায়। পুরোটা পেয়ে গেলাম🤍যিনি আপলোড করেছেন, আপনাকে কৃতজ্ঞতা।

    Like

Leave a reply to Anonymous Cancel reply