“মানুষের চেহারা কি চেঞ্জ হতে পারে? ”– ভদ্রলোক পা নাচাতে নাচাতে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন। ছোটোখাটো লোকটার মুখের ভাবখানা এরকম যে খুব বুদ্ধিমানের মতো একটা প্রশ্ন করে ফেলেছেন।
রাত গভীর হওয়ার আগেই আমাকে আবার বাসায় ফিরে যেতে হবে, কিছুক্ষন আগেও এই আতঙ্ক আমাকে অস্থির করে তুলছিলো। ফলে বয়স্ক এই ভদ্রলোককে দেখামাত্র আমি খুশি হয়ে উঠেছিলাম – রাত আটটায় চেম্বারে রোগী আসা মানেই আরো কিছুক্ষন বাসার বাইরে থাকতে পারা, সাথে বোনাস হিসেবে কিছু বাড়তি আয়-রোজগার।
“মানুষের চেহারা অবশ্যই চেঞ্জ হতে পারে।”– আমি সাহসের সাথে বললাম – “একটা ছেলে শিশু যখন জন্মায়, অনেকেই বলে ‘বাহ্, ওর চেহারা হয়েছে ঠিক তার মায়ের মতো’, কিন্তু সেই ছেলে যত বড়ো হতে থাকে ততই তার বাবার চেহারা পেতে থাকে। এরকম তো প্রায়ই হয়। তারপর মনে করেন, একটা মেয়ে শিশু জন্মালো, সবাই ভাবলো সে দারুন ফর্সা হয়েছে, কিন্তু যেই না সে কৈশোরে পা দিলো সাথে সাথে তার গায়ের রং শ্যামলা দেখাতে শুরু করলো, এমনকি একসময় ব্যাপারটা এমন জটিল হয়ে দাঁড়ালো যে বাজারে ত্বক ফর্সা করার ক্রিমের বিক্রি-বাট্টা বেড়ে গেলো। এসব তো হয়েই থাকে, তাই না?”
মিনহাজ সাহেবের বয়স প্রায় ষাট, কিন্তু তাকে দেখে ধারণা করা যায় তিনি নিয়ন্ত্রিত জীবন-যাপন করেন, মেপে মেপে খাওয়া-দাওয়া করে থাকেন। নাকের নিচে যত্ন করে ছেঁটে রাখা গোফ অস্বাভাবিকরকম কালো। দেখে বোঝা যায়, কৃত্রিম রং তার বাণিজ্যিক স্পর্শ রেখে গেছে ভদ্রলোকের মুখমন্ডলের ওই বিশেষ অংশে।
“না, ভাই, বয়সের সাথে মানুষের চেহারা বদলায়, এটা তো সবাই জানে। আমি বলছি পূর্ণবয়স্ক মানুষের কথা।” – টাইয়ের নটটা একটু আলগা করতে করতে বললেন তিনি।
“পূর্ণবয়স্ক মানুষের কথা?”
“হ্যা, মনে করেন, গত তিন মাসে আমার চেহারা এতটাই বদলে গেলো যে আমাকে আপনি চিনতেই পারলেন না। বাই দা ওয়ে, আমি প্লাস্টিক সার্জারি, মোবাইলের বিশেষ সফটওয়ার যেগুলো দিয়ে মেয়েরা ফেসবুকে নিজেদের বেশি আকর্ষনীয়া করে দেখায়, সিনেমার মেকাপ, বা এধরণের কোন কিছুর কথা বলছি না। আমি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প, গুয়ান্তানামো বে, আয়নাঘর, বা এরকম কোন অত্যাচারের জায়গার কথাও বলছিনা। নরমাল মানুষ, ব্যায়াম-ট্যায়ামও করে না, সাধারণ জীবন-যাপন করে, এরকম কারো চেহারা কি আপনা-আপনি চেঞ্জ হয়ে যেতে পারে? আপনার কি মনে হয়?”
আমি স্বীকার করলাম, এ ধরণের কিছুর কথা আমার ঠিক মনে পড়ছে না – চিকিৎসাবিজ্ঞানের পাঠ্যবইয়ে এধরণের কোন কেস পেয়েছি বলেও মনে করতে পারছি না।
“কিন্তু ঠিক এই ঘটনাটাই ঘটছে আমার স্ত্রীর জীবনে, বুঝলেন?” – আলোচনার এই পর্যায়ে এসে উনি ভেঙে বললেন মূল ঘটনা।
“আপনার স্ত্রীর জীবনে?”
“জ্বি। আমার স্ত্রীর জীবনে। আপনি চিন্তা করতে পারেন? সাড়ে তিন মাসের মধ্যে রাহেলার চেহারা এতটা বদলে গেলো যে নতুন পরিচিত লোকজন আমাকে জিজ্ঞেস করে সে আমার যমজ বোন কিনা। কি ভয়াবহ কথা! খুবই এম্ব্যারাসিং, ডাক্তার সাহেব।”
“যমজ বোন?”
“জ্বি, ডাক্তার সাহেব। যমজ বোন। গত তিন মাসে তার চেহারা বদলাতে বদলাতে আমার চেহারার মতো হয়ে গেছে। এখন আমাদের চেহারার এত মিল যে তাকে আমার নিজের কাছেই মাঝে মাঝে যমজ বোন বলে মনে হয়।”
আমি স্বীকার করতে বাধ্য হলাম, এই ধরণের পরিস্থিতি বেশ অস্বস্তিকর। যদিও সাথে সাথে এটাও যোগ করলাম যে, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক একসময় পিঠাপিঠি দুই ভাইয়ের মতো কিংবা পিঠাপিঠি দুই বোনের মতোই হয়ে যায় – সারাক্ষন একজন আরেকজনের পেছনে লেগে থাকে, আবার একজন অন্যজনকে ছাড়া থাকতেও পারে না। দাম্পত্যের এই রূপান্তর পুরোপুরি বিজ্ঞানসম্মত – আমি মত দিলাম।
সেদিন শরতের সেই সন্ধ্যায় আমার দশ-ফুট-বাই-আট-ফুট চেম্বারে ষাট ওয়াটের ইলেকট্রিক বাল্বের আলো সরাসরি মিনহাজ সাহেবের মুখের ওপর পড়ছিলো, আর তার কপালে জমে ওঠা ঘামের মিহি মিহি ফোঁটাগুলো জ্বল জ্বল করে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করছিলো। তার চেহারার দিকে কেন যেন একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিলাম আমি। তবে ভদ্রলোক আমার কথায় খুব একটা ভরসা করতে পেরেছেন বলে মনে হচ্ছিলো না। একটা খাম কর্পোরেট স্টাইলে আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে চলে যাবার আগে তিনি কথা দিলেন, পরের সপ্তাহেই তার স্ত্রী-কে সাথে নিয়ে আমার সাথে আবার দেখা করবেন।
“রাহেলার অসুখের ভয়াবহতা বুঝতে হলে তাকে আপনার একবার নিজ চোখে দেখতে হবে। ভেবেছিলাম, আপনাকে আমি নিজেই কনভিন্স করতে পারবো।” – বের হওয়ার সময় গজ গজ করতে দেখলাম যেন তাকে।
মিনহাজ সাহেব চলে যাওয়ার পর সেদিন চেম্বারে আরো অন্তত আধাঘন্টা অপেক্ষা করলাম, কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে আর কোন রোগী এল না। বাধ্য হয়ে আমাকে উঠতেই হলো, মনে মনে তৈরী হতে হলো জ্বলন্ত উনুন থেকে গিয়ে ফুটন্ত পানিতে ঝাঁপ দেয়ার জন্য। জানিনা, কেন আমার জীবনে বৌ-শ্বাশুড়ি দ্বন্দ্বের মতো অত্যন্ত সাধারণ একটা ঝামেলাই হতে হলো। ঢাকা শহরে আমি একজন উঠতি মনোবিদ, আমার জীবনে কি এর চেয়ে জটিল ও দুর্ধর্ষ কোন সমস্যা আসতে পারতো না? আশ্চর্য! ডাল-ভাতের মতো এই সমস্যা দিয়ে নিয়তি তো আমাকে রীতিমতো অপমান করেছে – বলতেই হচ্ছে ।
মিনহাজ সাহেবের এই কেসটা বরং আমার মতো বুদ্ধিমান মানুষের জন্য বেশি মানানসই – রিকশা করে বাসায় ফিরতে ফিরতে একবার মনে হলো। খুবই রহস্যময় কান্ড-কারখানা চলছে তার জীবনে। কিন্তু কি থাকতে পারে এর ব্যাখ্যা? ক্ষীণভাবে একবার মনে হলো, কোথায় যেন এরকম একটা কেস পড়েছি, কিন্তু ঠিক মনে করতে পারলাম না এটা কোন মেডিক্যাল জার্নালে ছিল নাকি মাসিক রহস্যপত্রিকার কোন সংখ্যায় পেয়েছিলাম।
যা ভেবেছিলাম, তাই। শান্তিনগরে এসে তিনতলার কলিংবেল টিপতেই দরজা খুলে দিলো মা, মুখ তার পাথরের মতো গম্ভীর। বললাম, “মুখ কালো কেন, মা?”
“আমার চেহারাটাই কালো, বাবা।” – উত্তর এলো। অথচ ‘মুখ কালো’ বলতে আমি গাত্রবর্ণের কথা বোঝাই নি।
বেডরুমে ঢুকে দেখি, মালিহা উপুড় হয়ে বিছানায় পড়ে আছে। চোখের কোনা দিয়ে আমাকে দেখে অতর্কিতভাবে বলে উঠলো – “তোমাকে আমি মনে-প্রাণে ঘৃণা করি।”
“ঘৃণা?”
“হ্যা, ঘৃণা করি। তোমার চেহারা দেখলেও আমার গা রি রি করে।”
“চেহারা দেখলে গা রি রি করে? কিন্তু কেন?”
“কারণ, তুমি স্বভাবে হয়েছো ঠিক তোমার মায়ের মতো। এমনকি তোমার চেহারাটাও তোমার মায়ের মতো। আজকাল তোমার চেহারা দেখলেই আমার তোমার মায়ের কথা মনে পড়ে, আর মাথায় আগুন ধরে যায়।”
“আগুন ধরে যায়?”
সে উত্তর দিলো না। আর কথা না বাড়িয়ে আমি সোজা ঢুকে গেলাম বাথরুমে। কিন্তু লাইট জ্বালাতেই স্বাভাবিকভাবে আমার চোখ পড়ে গেলো বেসিনের আয়নায়, আর সাথে সাথে আমার চোখ আটকে গেলো ওখানে। মালিহা তো ঠিকই বলেছে, আমার চেহারার সাথে তো মা-র চেহারার ভীষণ মিল! এতদিন আমি এটা খেয়াল করিনি কেন? আশ্চর্য তো, কিভাবে এটা সম্ভব! মায়ের সাথে কি আমার স্বভাবে আসলেও খুব মিল আছে? আর এটাই কি আমার স্ত্রীর আমাকে ঘৃণা করার একমাত্র কারণ? নাকি আরো কোন কারণ আছে তার মনের গহীনে?
মিনহাজ সাহেবের স্ত্রীর সাথে আমার দেখা হলো সপ্তাহ দুয়েকের ভেতর। মিনহাজ সাহেব তাকে উপদেশ দিয়েছেন আমার সাথে দেখা করতে, আর রাহেলা হক কোন প্রশ্ন না করেই এপয়েন্টমেন্টে রাজি হয়ে গেছেন। দেখা হবার পর তিনি সেটা স্বীকারও করলেন।
ভদ্রমহিলাকে দেখে আমি চমকে উঠলাম, তাকে দেখে মনে হচ্ছিলো মিনহাজ সাহেব গোঁফ কামাই করে মাথায় একটা ঘোমটা দিয়ে চলে এসেছেন – স্বামীর সাথে তার চেহারার এতটাই মিল। লোকজন যে মিসেস রাহেলাকে মিনহাজ সাহেবের যমজ বোন মনে করে, এতে অবাক হওয়ার কিছুই নেই।
মিনহাজ সাহেবকে জিজ্ঞেস করলাম, তার স্ত্রীর সাথে আলাদা করে কথা বলতে তার কোন আপত্তি আছে কিনা। তাকে ইতস্তত করতে দেখে আমি ফ্রন্টডেস্ক থেকে বলে রুমাকে ডেকে পাঠালাম, বললাম – “আমি আর ডক্টর রুমা মিলে উনাকে কয়েকটা প্রশ্ন করবো।” চোখ-মুখের অস্বস্তি লুকানোর চেষ্টা না করে মিনহাজ সাহেব তখন পাশের ঘরে গিয়ে বসলেন।
হলুদ ল্যাম্পের মৃদু আলোতে আমি তখন তাকে বললাম – “রাহেলা, আপনি জানেন, কেন আপনার সাথে আমি কথা বলতে চেয়েছি।”
“জ্বি, জানি।” – মেঝের দিকে স্থির তাকিয়ে থেকে তিনি উত্তর দিলেন।
“প্রথমে আমি ভেবেছিলাম, আপনার স্বামী আপনার ব্যাপারে কিছুটা বাড়িয়ে বলেছেন। এখন মনে হচ্ছে, তিনি একটুও বাড়িয়ে বলেন নি। আচ্ছা, আপনি কি সচেতন যে আপনার চেহারার একটা রূপান্তর হয়ে সেটা আপনার স্বামীর মতো হয়ে গেছে?”
“জি, আমি জানি।” – অকপটে স্বীকার করলেন ভদ্রমহিলা। আমি ততক্ষনে উনার বয়স আন্দাজ করার চেষ্টা করা বাদ দিয়েছি। স্বামীর সাথে তার চেহারা এবং শরীরের গড়ন, উচ্চতা, ইত্যাদির এতটাই মিল হয়ে গেছে যে বার্থ সার্টিফিকেট না দেখে আমি তার বয়স সম্পর্কে কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হবো না বলে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি।
“আপনি কি আপনার অল্প বয়সের কোন ছবি আমাকে আর ডক্টর রুমাকে দেখতে পারেন? মানে আপনার বিয়ের আগের ছবি? কিংবা বিয়ের পরপর হাসবেন্ডের সাথে যুগল কোন ছবি?”
ভদ্রমহিলা কোন উত্তর দিলেন না, কিন্তু আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই তার হাত চলে গেছে তার ভ্যানিটি ব্যাগের ভেতর। তার ব্যক্তিগত সম্পত্তির ভেতর থেকে মোবাইল ফোনটা বের করে তিনি নীরবে ছুটে চলতে শুরু করলেন এক এপ্প থেকে আরেক এপ্প-এ। কিছুক্ষন ঘাটাঘাটি করে নীরবে ফোনটা এগিয়ে দিলেন রুমার দিকে, যেন বেশ ক্লেশ স্বীকার করে বের করে এনেছেন রহস্যময় এক অজানা অতীতকে।
আমার কলিগ ডক্টর রুমা কিছুক্ষন চোখ কুঁচকে কি যেন পরীক্ষা করলো, তারপর আমার চোখের সামনে মেলে ধরলো রাহেলার মোবাইলের স্ক্রিন। একটা রং-চটে যাওয়া ছবি, বোঝাই যায় ডেভেলপ করে প্রিন্ট করা ফুজিফিল্মের কোন ফোটোগ্রাফকে স্ক্যান করে যত্ন সহকারে টিকিয়ে রাখা হয়েছে এই মোবাইলের স্মৃতির ব্যাংকে।
ছবিতে মহিলার চেহারার সাথে সেসময়কার মিনহাজ সাহেবের চেহারার কোন মিলই নেই। মিনহাজ সাহেবের গোফটা মার্কেটিং ব্র্যান্ড-এর বিজ্ঞাপন হয়ে তার যুবক বয়সের ছবিতেও দিব্যি সগর্বে ঝুলছিলো, আর তিনি তার চেহারায় কৃত্রিম একটা গাম্ভীর্য তখনো ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। অন্যদিকে রাহেলার চেহারায়ায় ছিল সুখী সুখী একটা ভাব, নতুন বিয়ে করা মেয়েদের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই যা উপস্থিত থেকে থাকে।
আমি বললাম – “আপনার চেহারায় তো বেশ হাসি-খুশি একটা ভাব ছিল। আপনি কি এখনো সেরকম সুখীই আছেন?”
“সন্তুষ্টিতেই আসল সুখ। আমি আমার জীবন নিয়ে সন্তুষ্ট।” – মাথা নিচু করেই তিনি উত্তর দিলেন।
“আপনি কি আপনার ওই বয়সে শুধুই সুখী ছিলেন? সন্তুষ্ট ছিলেন না?”
“ডাক্তার সাহেব, অনেক দিন আগের কথা তো। আমার ঠিক মনে নেই।” – এই প্রথম আমার চোখের দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে বললেন তিনি। তার সেই দৃষ্টি ছিল মাছের চোখের মতোই নিষ্পলক।
“আচ্ছা, আপনার আর কোন ছবি নেই কমবয়সের?” – মোবাইলটা রাহেলার দিকে ফিরিয়ে দিতে দিতে বললাম আমি।
তিনি আবার তার কার্যকারিতা দেখালেন, সেকেন্ডের কাটা মিনিটের কাটাকে আরেকবার পাড়ি দেয়ার আগেই বের করে আনলেন কিছু একটা, তারপর সেটা এগিয়ে দিলেন রুমার দিকে। আমি আর আমার কলিগ মিলে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিশ্চিত হলাম যে ওই রাহেলা আর এই রাহেলার মধ্যে কোন মিলই নেই।
“আপনাদের ছেলে-মেয়ে কয়জন?”
“আমাদের এক ছেলে, আর এক মেয়ে। ছেলেটা কলেজে যায়, মেয়েটা ভার্সিটিতে পরে।”
“তাদের চেহারাও কি মিনহাজ সাহেবের মতো?”
“জি। বাবার সাথে ছেলে-মেয়ে দুজনেরই চেহারার অসম্ভব মিল। জানেন, এখনো মেয়ে আমার বাবাকে জিজ্ঞেস না করে কিছু করে না, এত লক্ষী। ছেলেটাও ব্যাচে পড়তে গিয়ে বাবাকে ফোন করে জানায় পৌঁছেছে কিনা। আমরা ওদেরকে এভাবেই বড়ো করেছি। ওরা আমাদের ছাড়া চলতেই পারে না, মাশাআল্লাহ।” – সন্তানদের কথা বলতে গিয়ে মহিলার মুখে কিছুটা রক্ত ফিরে এলো, তাকে আবার জীবিত মানুষ বলে মনে হতে শুরু করলো আমাদের কাছে।
এই সমস্যার কোন চিকিৎসা আমার জানা ছিল না বলে আমি মিনহাজ-রাহেলা দম্পতিকে সেদিনের মতো বিদায় নিলাম। ব্যর্থতার দায় স্বীকার করে তাদের কাছ থেকে ভিসিট নেয়া থেকেও বিরত থাকলাম।
তবে মিনহাজ সাহেবের স্ত্রীর বিষয়ে আমি হাল ছেড়ে দিলাম না। উনি যখন আমার কাছে এসেই পড়েছেন, ধরে নিতে হবে তার দায়িত্ব আমার জন্য ঈশ্বর প্রদত্ত। স্টাডির সাথে সাথে দোয়াও চালিয়ে গেলাম, কেননা সাফল্যের জন্য চেষ্টা ও ভাগ্য দুটাই সমান জরুরি।
প্রায় দেড় সপ্তাহ পর মিনহাজ সাহেবকে ফোন করে চেম্বারে আসতে অনুরোধ করতে সক্ষম হলাম। সমস্যাটার একটা কেস স্টাডি পেয়েছি জানিয়ে তাকে একাই আমার সাথে দেখার করতে বললাম। সে বিকেলেই তিনি ঘড়ির কাটা মেনে আমার চেম্বারে হাজির হলেন।
ভদ্রলোককে জানালাম যে ইন্টারনেটের কল্যানে আজকাল গবেষণার কাজ অনেক সহজ হয়ে গেছে। বললাম, ব্রিটিশ একটা নেচারোপ্যাথিক মেডিসিনের অখ্যাত এক জার্নালে অনেক পুরোনো একটা কেস খুঁজে পেয়েছি আমি, যার সাথে মিনহাজ সাহেবের কেসের বেশ মিল আছে। ১৯৫৬ সাথে মিডলসবোরোর এক গ্রামে মার্গারেট ল্যাংডন নাম এক নিরীহ গৃহবধূর সাথে এমন ঘটনা ঘটেছিলো। পাঁচ মাসের ব্যবধানে মার্গারেটের চেহারা বদলে তার স্বামী জন ল্যাংডনের মতো হয়ে গিয়েছিলো।
“মার্গারেট নামের ওই মহিলার সমস্যার কি সমাধান হয়েছিল?” – উত্তেজিত মিনহাজ সাহেব জানতে চাইলেন।
“হ্যা, কিন্তু তার আগে ডক্টর রয় এটকিন্সকে রোগের কারণটা খুঁজে বের করতে হয়েছিল। ডক্টর রয়ই সেই ব্যক্তি, যিনি ওই জার্নালে লেখাটা একটা মেমোয়ার হিসেবে লিপিবদ্ধ করেছিলেন।”
জার্নালের একাডেমিক বিষয়ে বলার আগ্রহ আমার যতটা বেশি, মিনহাজ সাহেবের সেটা শোনার আগ্রহ ততটাই কম ছিল বুঝতে পেরে আমি মূল বিষয়টার অবতারণা করতে আর দেরি করলাম না। গম্ভীর মুখে উনাকে জিজ্ঞেস করলাম – “মিসেস রাহেলা সপ্তাহে কয়দিন আপনার সাথে ঝগড়া করে?”
“একদিনও ঝগড়া করে না। কিন্তু সে প্রসঙ্গ আসছে কেন?”
“রাগ-অভিমান করেন না?”
“রাহেলার কোন রাগ বা অভিমান নেই।”
“কোন বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করেন না?”
“মত থাকলে তো দ্বিমত হবে।”
“আপনার বাসায় সিদ্ধান্তগুলো তাহলে কি ভাবে হয়?”
“সিদ্ধান্ত আমি নিই, কারণ আমি যা বুঝি সে তা বোঝে না। সেও সিদ্ধান্ত নিতে চায় না।”
“ল্যাংডন সাহেবের কেসে হুবহু এই ঘটনাই ঘটেছিলো, মিনহাজ সাহেব। তার ঘরেও তার স্ত্রী মার্গারেটের কোন বক্তব্য ছিল না।”
“কিন্তু এর সাথে চেহারা বদলানোর সম্পর্ক কি?”
“সম্পর্ক কি, জানি না। কিন্তু মার্গারেটের আগের চেহারা ফিরিয়ে আনার জন্য ডক্টর রয় এটকিন্সকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছিল। মূল চেহারায় ফিরিয়ে নিতে রয়ের সময় লেগেছিলো প্রায় আড়াই বছর আসলে। একটা দালান ধ্বংস করতে সময় লাগে না, কিন্তু সেটাকে পুনরায় গড়ে তুলতে সময় লাগে।”
“চিকিৎসা পদ্ধতি কি ছিল? এলোপ্যাথি, না হোমিওপ্যাথি?”
আমি লম্বা করে একটা শ্বাস নিলাম – “বিষয়টা আসলে ইন্টারেস্টিং। মার্গারেটকে ডক্টর এটকিন্সের শেখাতে হয়েছিল, কিভাবে তার স্বামী মিস্টার ল্যাংডনের সাথে ঝগড়া করতে হবে। পুরোপুরি ঝগড়াটে না হয়ে ওঠা পর্যন্ত মার্গারেটের মূল চেহারা ফেরত আসে নি। বুঝতেই পারছেন, নিরীহ একজন রোগীকে ঝগড়া ও দ্বিমত পোষণ করতে শেখানো ওরকম একটা প্রতিক্রিয়াশীল সমাজে সহজ কোন কাজ ছিল না।“
“বলেন কি?” – অনেক চেষ্টা করেও মিনহাজ সাহেব তার চেহারা থেকে বিস্ময় লুকাতে পারছিলেন না।
“জি,” – আমি বললাম – “জার্নাল আর্টিকেলের বিশ্লেষণ অধ্যায়ে ডক্টর এটকিন্স লিখেছেন, মতামত প্রকাশ করার স্বাধীনতা কোন না কোনভাবে মানুষকে তার জন্মগত চেহারা ধরে রাখতে সাহায্য করে, যদিও তিনি জানেন না ঠিক কিভাবে এই প্রক্রিয়াটা ঘটে থাকে। তার ধারণা, স্বামীর সব কথা মেনে নেয়ার ফলশ্রুতিতে মার্গারেটের নিজস্ব মতামতগুলো ক্রমাগত চাপা পড়ে যাচ্ছিলো, আর এরই বিরল পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছিল চেহারার এই আকস্মিক বদল। তিনি দাবি করেছেন, মত প্রকাশের স্বাধীনতা পাওয়ার সাথে সাথে মার্গারেট যে তার মূল চেহারা ফিরে পেতে শুরু করলো, এটাই পরিষ্কারভাবে ইঙ্গিত করে যে তার হাইপোথিসিস সঠিক। উপসংহারে তিনি অবশ্য স্বীকার করেছেন যে চেহারা ফেরানোর এই চিকিৎসার দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব তার অজানা, সুতরাং এটা ভবিষ্যতে বিস্তারিত গবেষণার দাবি রাখে।”
আমার কথা সম্ভবত মিনহাজ সাহেবের মনে দৃঢ় ও স্থায়ী কোন দাগ কাটতে পারলো না, তিনি সঠিকভাবে সম্ভাষণ না জানিয়েই বিদায় নিলেন। যাবার আগে অবশ্য ভিসিটের টাকা পুরোই পরিশোধ করে গেলেন।
ঐদিন চেম্বারে রোগীর ভিড় ছিল, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় এরকম থাকে, আমার বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত এগারোটা বাজলো। ঘরে ফিরে দেখি, মা শুয়ে পড়েছে, আর মালিহা মন দিয়ে হিন্দি সিরিয়াল দেখছে আর মাঝে-মধ্যেই তার চোখ ছল ছল করে উঠছে। পুরো নারী জাতিকে এড়িয়ে বাথরুমে ঢুকে যেতে যেতে ভাবছিলাম – আর মাত্র কয়েকটা দিন, তারপরই সমাধান হবে এই আদিম সমস্যার। আর মাত্র কয়েকটা দিন।
মাস চারেক পর মিনহাজ সাহেবের সাথে আমার দেখা হয়ে গেলো বসুন্ধরা শপিং মলের দোতলায়, দূর থেকে দেখি এক ভদ্রমহিলাকে সাথে নিয়ে তিনি চটপটির দোকানে ফুচকা খাচ্ছেন। নিজের স্ত্রীকে রেখে অন্য আরেকজনকে নিয়ে যেসব লোক মার্কেটে মার্কেটে ঘোরা-ফেরা করে, তাদেরকে ব্যক্তিগতভাবে আমার ভীষণ অপছন্দ হয় বলে তাকে সচেনতনভাবে এড়িয়ে যেতে চাচ্ছিলাম, কিন্তু তিনি কি করে যেন আমাকে দেখে ফেললেন। কাছে এসে জোর করে হাত মেলালেন, তারপর প্রায় টেনে নিয়ে গেলেন তাদের নির্ধারিত টেবিলের দিকে। তারপর ওই ভদ্রমহিলাকে বললেন – “রাহেলা, চিনতে পারছো ডাক্তার সাহেবকে?”
এই মুহূর্তে আমার মনে পড়ে গেল, কেন উনাকে আমার পরিচিত লাগছে। আরে, এতো মিসেস রাহেলার সেই বিয়ে পরবর্তী হাসি আর চেহারা, যদিও আমাকে দেখে ভদ্রমহিলার মুখের হাসি কিছুটা মিলিয়ে গেলো।
“রাহেলা, ডাক্তার সাহেবকে তোমার মনে নেই? উনিই তো তোমার চেহারা ঠিক করে দিলেন।“ – রাহেলার কপালে ভাজের চিহ্ন লক্ষ্য করেই হয়তো বললেন তিনি – “ডাক্তার সাহেব ওই মেডিক্যাল জার্নাল খুঁজে না পেলে তোমার-আমার যে কি হতো, বলা মুশকিল।”
এদিকে ঘটনার আকস্মিকতায় আমার মাথা ততক্ষনে চক্কর খাওয়া শুরু করেছে, কিন্তু আমি থমকে দাঁড়ালাম ও চমকে তাকালাম যখন মিসেস মিনহাজকে চিবিয়ে চিবিয়ে বলতে শুনলাম – “ফালতু কথা বলা কি তুমি বন্ধ করবে? ডাক্তার কি রোগ সারাতে পারে? রোগ সারায় তো খোদা তায়ালা। তুমি দেখছি নিজের জন্য জাহান্নামের রাস্তা খুলতে শুরু করেছো।”
দমকা বাতাসে নিভে যাওয়া মোমবাতির মতো মিনহাজ সাহেবের চেহারা মুহূর্তের মধ্যে অন্ধকার হয়ে গেলো, করুন দৃষ্টিতে একবার আমার দিকে আরেকবার রাহেলার দিকে তাকাতে লাগলেন। স্পষ্টতই তিনি ভীষণ বিব্রত হয়ে যাচ্ছিলেন দেখে তাড়াতাড়ি বললাম – “আপা একেবারেই ঠিক কথা বলেছেন। আমি আপনার সাথে পুরো একমত। আমরা কেবল চেষ্টাই করতে পারি, ফলাফল উনার হাতে।”
আমার কথা শুনেই হয়তো শক্ত হয়ে যাওয়া রাহেলার চোয়াল কিছুটা নরম হয়ে এলো। বললেন – “ওর কথায় কিছু মনে করবেন না, ডাক্তার সাহেব। যত বয়স বাড়ছে, ততো তার কথাবার্তার কন্ট্রোল কমে যাচ্ছে। একটা উদাহরণ দিলেই বুঝবেন, সেদিন হয়েছে কি, মিনহাজ অফিস থেকে কেবল ফিরেছে। সে কি, আপনি দাঁড়িয়ে কেন? বসুন, পুরো ঘটনাটা আপনাকে খুলে বললেই না। বলছিলাম, সে অফিস থেকে ফিরেছে। কি বার ছিল যেন সেটা, মিনহাজ। আরে, তুমি দেখছি কিছুই মনে রাখতে পারো না, … … …” – ইত্যাদি, ইত্যাদি।
সেই অদ্ভুত সন্ধ্যায় রাহেলা হকের বকবকানিতে আমার মাথাটা ধরে গেলেও বেশ খুশি মনেই আমি বাসায় ফিরলাম। বাসা মানে মালিহা আর আমার নতুন নীড়, মিরপুর ডিওএইচএসে ভাড়া করা ফ্ল্যাট বাড়ি। মা অনেক পীড়াপীড়ি করেছিল যেন শান্তিনগরের বাসা ছেড়ে বাইরে চলে না আসি, কিন্তু আমি ভাবলাম একদিন না একদিন তো বাবা-মা থেকে বিচ্ছেদ হবেই – শান্তির স্বার্থে সেটা না হয় কয়েক বছর আগেই হলো। বাবা পর্যন্ত অনেক মন খারাপ করলো, একান্নবর্তী পরিবারের পুরাতনপন্থী আবেগ আরকি – অথচ ভবিষ্যৎ সবসময়ই অতীতের চেয়ে বেশি গুরুত্ব বহন করে, সেটা তার বোঝা উচিত ছিল।
বাসায় ফিরে একতলার কলিংবেলে টিপ দিতেই দরজা খুলে দিলো মালিহা, যেন এতক্ষন আমার অপেক্ষাতেই ওঁৎ পেতে বসেছিল ওর মনমতো নতুন করে সাজানো ড্রইংরুমে। ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করামাত্র সে আমাকে বিলেতি স্টাইলে জড়িয়ে ধরলো। তার কপালে একটা অ-ফ্রয়েডীয় চুমু এঁকে দিয়ে ফ্রেশ হওয়ার জন্য বাথরুমে ঢুকলাম। লাইট জ্বালানোর সাথে সাথে চোখ পড়ে গেলো সাদা বেসিনের ওপরের টলটলে স্বচ্ছ আয়নায়। আর আমার চোখ রীতিমতো আটকে গেলো ওখানটাতে।
এ আমি কাকে দেখছি? এটা কি সেই আমি?
হতে পারে এটা শক্তিশালী লাইট ফিটিংসের কারসাজি, কিন্তু আয়নাতে আমাকে সত্যিই আগের চেয়ে অনেক ফর্সা দেখাচ্ছে। স্বস্তির খবর হলো, মালিহা আর কোনোদিন খোঁটা দিয়ে বলতে পারবে না – আমি আমার মায়ের মতো কালো। কিন্তু অস্বস্তির বিষয় হলো, আমার চেহারাটা আর আমার মতো নেই – সেটা বদলে গেছে, হঠাৎ করেই সেটা বদলে যেতে শুরু করেছে। আর সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, বদলে গিয়ে আমার চেহারাটা এই মুহূর্তে দেখাচ্ছে অনেকটা মালিহার মতো, যেন কোন জাদুর কাঠির ছোঁয়ায় আমার চেহারা বদলে ওর মতো হয়ে গেছে। এমনকি ওর সাথে আমার চেহারার মিলের ব্যাপ্তি লক্ষ্য করে একসময় আমার এরকম আশঙ্কাও হলো, এভাবে চলতে থাকলে নিকট ভবিষ্যতে কোন একদিন আমাকে ওরা সবাই মালিহার যমজ ভাই বলেই ভাবতে শুরু করবে।
বাথরুম থেকে বের হওয়ার পর থেকে নিজের চেহারা সংক্রান্ত নানাবিধ আশংকা আমাকে এমনভাবে জেঁকে ধরলো যে সে রাতে সারারাত ঘুমাতে পারলাম না। এক ফোটাও ঘুমাতে পারলাম না।

ভালো লাগলো
LikeLiked by 2 people
অসাধারণ
LikeLiked by 1 person