আড়াই তলার ভাড়াটিয়া

নাখালপাড়ার ছয়তলা এই ভাড়া বাড়ির দোতলা আর তিনতলার মাঝে যে লুকোনো আরেকটা তলা আছে, আমি জানি সুস্থমস্তিষ্কের কেউই এটা বিশ্বাস করবে না। কিন্তু যেটা আমি নিজে দেখেছি, যেখানে আমি নিজে গিয়েছি, সেটা আমি কিভাবে অস্বীকার করবো !

আবেগের বশবর্তী হয়ে একবার তোমাকে বলে ফেলেছিলাম আমার আড়াইতলার ফ্ল্যাটের কথা, তুমি হেসে উঠলে। আমি মুগ্ধ বিস্ময়ে তোমার দিকে তাকিয়ে থাকলাম, কারণ তোমার তাচ্ছিল্যের হাসিও আমার জন্য ছিল অমূল্য।

তুমি অবশ্য ভাবলে, আমি তোমার সাথে দুষ্টুমি করছি। তাই তুমিও পাল্টা দুষ্টুমি করলে, নীল শাড়ির আঁচল হাতের মুঠোয় ধরে দোতলার সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে বললে – “এই দেখো, আমি মোট আঠারো ধাপ সিঁড়ি ভেঙে যেখানে উঠে এলাম এখানে দোতলার শেষ, আর ঠিক এখন থেকেই তিনতলার শুরু। মানে দোতলার যেটা সিলিং, তিনতলার সেটাই ফ্লোর। তাহলে তোমার আড়াইতলাটা কোথায়, মিস্টার?”

আমি কিছু বললাম না। কিছু মনেও করলাম না। আমার আড়াইতলা আমার কাছেই থাকুক। জীবনের সব অভিজ্ঞতা যে সবার সাথে শেয়ার করতে হবে, এমন তো কোন কথা নেই।

দ্বিতীয় আর তৃতীয় তলার মাঝখানে পড়েছে বলে আড়াই তলায় আমার ঘরে সিঁড়ি দিয়ে যাওয়া যায় না। ওখানে যেতে হলে লিফ্ট ব্যবহার করতে হয়। লিফটে উঠে একসাথে দুই আর তিন নম্বর সুইচ টিপে ধরতে হয়, তারপর এভাবে ধরে রাখতে হয় ঘড়ি ধরে কমপক্ষে তিরিশ সেকেন্ড, তাহলেই শুধু আড়াইতলার ওই ফ্ল্যাটের সামনে লিফটের দরজা খুলে যায়।

এই গোপন কথাটা সম্ভবত এই পৃথিবীতে শুধু আমিই জানি। অবশ্য বাড়িওয়ালার স্ত্রী জানতে পারে। কিরকম যেন সন্দেহজনক তার আচরণ, কেমন করে যেন তাকিয়ে থাকে আমাকে দেখলে। উনি কি জানেন, আমি এই ফ্ল্যাটের সন্ধান পেয়ে গেছি ? কে জানে ? 

আমি সুযোগ পেলেই এই ফ্ল্যাটে এসে লুকিয়ে থাকি। লুকিয়ে লুকিয়ে বই পড়ি। না হয় চিন্তা করি। কেউ জানে না। আমিই শুধু জানি। প্রায়ই আসি আমি এখানে। বিশেষ করে মন খারাপ থাকলে, আর তোমার ওপর রাগ হলে তো কথাই নেই। কিন্তু গত কয়দিন হয়, আমার আড়াই তলার সেই ফ্ল্যাটে একটা ইঁদুর ঢুকেছে। দ্বিধা? সন্দেহ? হতে পারে।

হতে পারে, এটা একটা সন্দেহ। অনেক কিছু নিয়েই আমার সন্দেহ আছে – আইডিয়াল হাই স্কুলে যা পড়িয়েছে তা নিয়ে সন্দেহ, কাটাবন মসজিদে যে ধর্মচর্চার কথা বলে তার ভেতর ঈশ্বর-বিশ্বাসের অংশ নিয়ে সন্দেহ, ফার্স্ট ইয়ারে পড়ার সময় যে দলের হয়ে রাস্তায় মিছিলে নেমেছিলাম তাদের উদ্দেশ্য আর দেশপ্রেম নিয়ে সন্দেহ, বাবা-মা আমাকে ভালোবাসে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ, এরকম আরো কত সন্দেহ আর দ্বিধা!

সত্যি কথা বলতে কি, মাঝে মাঝে আমার নিজের অস্তিত্ব নিয়েও সন্দেহ হয় – “আমি” বলতে আদৌ কি কেউ আছে? দেকার্তে অবশ্য বলেছিলেন – আমি যে চিন্তা করছি, এটাই তো প্রমাণ যে আমি আছি।

সলিমুল্লা হল থেকে সরকারি দলের লোকজন যেদিন আমাকে বের করে দিল, সেদিন সারাদিন পিঠে একটা পুটলি আর হাতে চামড়া ওঠা কালো একটা সুটকেস নিয়ে সারা ঢাকা শহর চষে বেড়ানোর পর সূর্যাস্তের ঠিক পর পর – যে সময়টায় মানুষের সন্ধ্যাভ্রম হয়, চেনা গলিকেও অচেনা পথ মনে হয় – এই এপার্টমেন্ট বিল্ডিংটা খুঁজে পেয়েছিলাম।

টিনের একটা কালো সাইনবোর্ডে সাদা রং দিয়ে কাঁচা হাতে লেখা ছিল – “এখানে ব্যাচেলরদের বাসা ভাড়া দেয়া হয়।” কিন্তু কোন ঘর সেদিন খালি ছিল না। সাদা পাঞ্জাবি পরা সফেদ দাড়িওয়ালা বৃদ্ধ বাড়িওয়ালাকে অনেক অনুরোধের পর চরম বিরক্তি চেপে রেখে সে বললো – ছাদে একটা ঘর আছে, কিন্তু সেটা নির্মাণ সামগ্রী রাখার জন্য মূলত তৈরী।

আমার যাওয়ার কোন জায়গা ছিলোনা, ফলে এ ঘরেই উঠতে রাজি হলাম। ভাড়াও ছিল কম, মাসে মাত্র চার হাজার তিন শো টাকা। যদিও দুপুর বেলা টিনের চালে সূর্যের আলো চুলা জ্বালাতো প্রতিদিন। আর রাতে প্রায়ই আমার দম বন্ধ হয়ে আসতো।

এর মধ্যেই একদিন ঘটলো এক অদ্ভুত ঘটনা। আমার মতো “ইয়াংম্যানের” লিফ্ট ব্যবহারে বাড়িওয়ালার আপত্তি ছিল, যদিও সুযোগ পেলেই আমি লিফটে ওঠা-নামা করতাম। একদিন বিকেলে এরকম লিফটে করে নামছি।

প্রথম দিন থেকেই দেখেছি, লিফটটা পুরোনো। মেঝের ছাল উঠে গেছে, দেয়ালের রং ফিকে হয়েছে, ওঠা-নামার সময় তীব্র ঘট ঘট শব্দ করে বলে ভয় লাগে। আজ আবার মফিজ চাচা নেই, একলা নামতে হচ্ছে। তার মধ্যে একতলার সুইচ টেপার সাথে সাথে তীব্র ঘটাং একটা শব্দে আমার কানে তালা লেগে যাবার অবস্থা হলো। কি হতে যাচ্ছে বুঝে ওঠার আগেই লিফ্ট চলতে শুরু করলো, কিন্তু গতিটা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি মনে হলো।

শুধু তাই না, চোখের পলক ফেলার আগেই লিফটের গতি বাড়তে শুরু করলো। যখন আমার নিজেকে ভরশূন্য মনে হতে শুরু করেছে, ততক্ষনে চারিদিক অন্ধকার হয়ে গেছে। কেন যেন আমার চোখের সামনে ভেসে উঠতে শুরু করেছে মায়ের চেহারা। মা-কে অনেকদিন দেখি না, কিন্তু এখন যেন চোখের সামনে তার মুখের প্রতিটা রেখা দেখতে পাচ্ছি।

বাঁধন ছিড়ে লিফ্ট যখন নিচে পড়ে, তখন কি মানুষ আহত হয়? নাকি মরেই যায়? মরার আগে কি ভীষণ ব্যথা পায়? নাকি ব্যথা অনুভব হওয়ার আগেই চেতনা শেষ হয়ে যায়? এসব আবোল-তাবোল যখন ভাবছি, তখন হঠাৎ করেই একটা ভীষণ ঝাকি দিয়ে লিফটটা থেমে গেলো আর আমি ছিটকে লিফটের একপাশে পড়লাম। সেই মুহূর্তে লাইট ফিরে এলো।

আমি হামাগুড়ি দিয়ে কোনোমতে লিফটের দরজার কাছে গিয়ে অসংখ্যবার একতলার সুইচ টিপলাম। আর তখনি দেখলাম, দোতলা আর তিনতলার সুইচের লাইট একসাথে জ্বলে রয়েছে। আমি যত যাই করি না কেন, সেই দুটা সুইচে আলো জ্বলে থাকে। লিফটটা সম্ভবত দোতলা আর তিনতলার মাঝখানে এসে আটকে গেছে, আমি ধারণা করলাম।

অনেকক্ষন দরজা ধাক্কানোর পর হঠাৎ করেই লিফটের দরজা খুলে গেলো, নিজে থেকেই। আশে-পাশে কোথাও কেউ নেই, নেই কোন সাড়া-শব্দ ওই মুহূর্তে। হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে এসে দেখি অবাক করা এক দৃশ্য, আস্ত একটা শূন্য ফ্ল্যাট আমার চোখের সামনে। ঘরের ভেতর কেমন যেন অপার্থিব একটা আলো। একটামাত্র জানলা ঢোকার দরজার ঠিক উল্টো পাশে। পা টেনে টেনে ওই পাশে গিয়ে দেখলাম, জানলা খোলা যাচ্ছে।

জানলায় কোন গ্রিল নেই, একপাশের পাল্লা খুলে মাথা বের করে দিলাম, তারপর ওপরে তাকালাম। গুনে দেখলাম আমার মাথার ওপর তিন, চার, পাঁচ, তারপর ছয়তলা। নিচে তাকিয়ে দেখি দোতলা আর একতলা। ছয়তলা একটা বিল্ডিঙে লুকোনো একটা তলা আছে। অবিশ্বাস্য ! ছয় আর সাত কি তাহলে একই সংখ্যা? নাকি সংখ্যা বিষয়টাই অর্থহীন ?

কোথায় যেন শুনেছিলাম, এক থেকে নয় মধ্যে একটা লুকোনো সংখ্যা আছে। সেই সংখ্যা যে বের করতে পারবে, সেই বুঝে উঠতে পারবে এই বিশ্বজগতের রহস্য। আমি কি সেরকম কিছু খুঁজে পেয়েছি?   

যাহোক, এতকিছু ভেবে কাজ নেই। চার হাজার টাকায় ব্যস্ত এই নগরে মাথা গোজার একটা ঠাঁই পেয়েছি, তার সাথে পেয়েছি বোনাস একটা ঘর। কিভাবে এটা এলো, সে নিয়ে আমার না ভাবলেও চলবে।

সেই থেকেই এখানে প্রতিদিন আসি আমি। দিনে অন্তত একবার আসি। তিন বছরের বেশি সময় ধরে এ বাড়িতে আছি। এখান থেকেই তো ভার্সিটি পাশ করলাম, আর পাশ করে বের হবার দিন কয়েকের মধ্যেই আবিষ্কার করলাম, আমার এই ঘরটা একেবারেই ফাঁকা – দিন-রাত অদ্ভুত এক শূন্যতা হাহাকার করে ওখানে। শুধু মাঝে-মধ্যে একটা ন্যাংটা ইঁদুর ঘরটার এক পাশ থেকে অন্য পাশে দৌড়ে চলে যায়। ভীষণ অস্বস্তি তৈরী করার জন্যই বোধহয় সে ওটা করে। 

এক বৈশাখের দিনে রোদের ভেতর হাটতে হাটতে মনে হলো, ঘরটা আসবাব-পত্র দিয়ে ভরে ফেলা দরকার। যথেষ্ট জিনিস-পত্রে জায়গাটা ঠাসা-ঠাসি হয়ে থাকলে ইঁদুরটা সম্ভবত আমাকে আর বিরক্ত করবে না, কোন একটা আসবাবের মধ্যে সে তার বাসা করে নেবে – ফলে সেও ভালো থাকবে, আমিও ভালো থাকবো, বাণিজ্যের ভাষায় যাকে বলা যাবে “উইন-উইন” সমাধান। সেই নির্জন তপ্ত দুপুরে কার্জন হলের সামনে দিয়ে হেটে যেতে যেতে আমার সেটাই মনে হলো।

সেদিন থেকে আমার বসবাসের সেই সে ঘরটা পূরণ করতে শুরু করলাম আসবাব-পত্র দিয়ে। ভালোবাসলাম আড়াইতলার আমার এই ঘরটাকে, আর টবের ভেতরকার গোলাপ গাছদুটোকে। ভালোবাসতে চেষ্টা করলাম জানলার পাশের সিঙ্গেল খাটটাকে, যেটাতে শুয়ে আমি মনের চোখে স্মৃতির পাতায় দেখতে পেতাম এক চিলতে আকাশ আর এভাবে প্রতিদিন প্রতিরাতে অসীম আকাশটাও আমার সসীম ঘরের অংশ হয়ে যেত। আর এভাবে বসার চেয়ার, লেখার টেবিল, পুরোনো বইয়ে ঠাসা বুকশেলফ, হলুদ ল্যাম্পও আমার ঘরের অংশ হয়ে গেলো।

এভাবে ঘরে ফার্নিচার ভর্তি করে আমি সুখীই ছিলাম। কিন্তু সমস্যা হলো, যখন এনজিও প্রজেক্টটা শেষ হয়ে গেল। বকেয়া ভাড়া শোধ করতে গিয়ে আমার এত সাধের আসবাবগুলো সব বিক্রি করে দিতে হলো – পড়ার কালো টেবিল, বসার সাদা চেয়ার, বইয়ের তাক, ল্যাম্প, সব। আমার দুঃখে দুঃখী হয়েই কিনা কে জানে, গোলাপ গাছটাও একরাতে গেলো মরে – পিতাজি আদম থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত আমার যত পূর্বপুরুষ মাটির নিচে শুয়ে আছেন, সবার কথা একসাথে মনে করিয়ে দিয়ে ঝরে পড়লো তার সবগুলো পাতা এক রাতের ভেতর।

কিন্তু ঘর আসবাবশূন্য হয়ে যাবার সাথে সাথে আবার সে ঘরে ভীষণ অস্বস্তি হয়ে মাঝে-মধ্যেই আবার উঁকি দিতে শুরু করলো ছোট অস্থির ধূসর রঙের সেই ইঁদুরটা। দ্বিধা? হতে পারে।

এরপরই ঘটলো সেই ঘটনা, তোমার সাথে দেখা হলো আমার। আমাদের ছোট্ট গবেষণা প্রজেক্টের ডাইনিং রুমে তুমি যখন আমার সাথে দুপুরের খাবার খেতে খেতে অনেক গল্প করতে, আমার দিনটাই সুন্দর হয়ে যেত। আমার ব্যক্তিগত আড়াই তলায় ফিরে এসেও ভাবতে থাকতাম তোমারি কথা, আর এভাবেই আমার ঘরে আবাস গড়ে নিলো তোমার স্মৃতিগুলো, একসময় তোমার ছায়া আধো-অন্ধকার সেই আড়াই তলা জুড়ে সারাদিন ঘুরে-ফিরে বেড়াতে লাগলো – কখনো হালকা সবুজ শাড়িটা পরে, মাঝে মাঝে শাড়ি ছাড়া।

ঢাকার থেকে কিছুটা বাইরে শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ে হাটতে গিয়ে এক বিকেলে তুমি আমাকে বলেছিলে সুখী হওয়ার মূলমন্ত্র। তুমি বলেছিলে – একদিন তোমার অনেক টাকা-পয়সা হবে, বছর বছর বাড়িভাড়া বেড়ে যাওয়া নিয়ে তোমার বাবা যে রকম পেরেশানিতে থাকে সেরকম উৎকণ্ঠা থেকে মুক্ত হয়ে জীবন কাটাতে পারবে তুমি, আর সেদিনই তুমি হবে সুখী আর পরিপূর্ণ হবে তোমার জীবন।

সেই শেষ বিকেলে নদীতীরের খোলা বাতাসে হাটতে হাটতে আমি একমত হতে পারি নি তোমার সাথে। আমার ধারণা ছিল – মানুষ কোনোদিন এই পৃথিবীতে সুখী হতে পারবে না, কিছু একটা নেই এই পৃথিবীতে। যদিও আমি জানতাম না, কি সেই “কিছু একটা” জিনিস। দ্বিধা? সন্দেহ? হতে পারে।

আমি শুধু জানতাম,  আমি সেই “কিছু একটা” থেকে বিচ্ছিন্ন, আর জন্মের মাধ্যমেই শুরু হয়েছিল আমার সেই বিচ্ছেদ। সেদিক থেকে চিন্তা করলে, ওই বিচ্ছিন্নতা প্রায় পুরোপুরি জেনেটিক – আমার ডিএনএ-সংশ্লিষ্ট কোন জন্মগত বৈশিষ্ট্য। আর এসবই ইঙ্গিত করে যে, মৃত্যুর মাধ্যমেই এই যন্ত্রণার একটা অবসান হলেও হতে পারে – কোন একদিন।

“তোমার মতো লোক তাহলে কিসে সুখী হবে?” – গোলাপি ঠোঁটের কোণে হাসি লুকিয়ে রেখে জানতে চেয়েছিলে তুমি। 

“ইঁদুরটা ঘর থেকে উধাও হলে।” – অন্যমনস্কভাবে বলেছিলাম আমি – “খুব বিরক্ত করছে ওটা আমাকে, কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না। কেমন করে যেন বার বার আমাকে খুঁজে পায় ওটা।”

“ট্র্যাপ দিয়ে ধরছো না কেন ওটাকে?”

“জানি না কেন। মনে হয় মায়া পড়ে গেছে।”       

আড়াই তলার আমার ব্যক্তিগত ঘরে ফিরে ইঁদুরটাকে প্রায়ই দেখতাম ঘরের কোণে বসে কুটকুট করে কি যেন কামড়াচ্ছে, আর মাঝে-মধ্যে বিন্দুর মতো কালো দুটো কুতকুতে চোখে আমার দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবছে। সেই দিনগুলোতে ওটাকে ভুলে থাকার আমার একমাত্র উপায় ছিল তোমার ধ্যান, কল্পনা করা যে তুমি বসে আছো চৌকিটার ওপর একপাশে, আর ইঁদুরটা ঢাকা পড়েছে তোমার ওড়নার আড়ালে। 

সেই তোমার ছায়াও একদিন আমার আড়াই তলা থেকে পালিয়ে গেলো দূরে কোথাও। তুমি তোমার বিয়ের কার্ড হাতে নিয়ে হাসি হাসি মুখে খবরটা বললে যেদিন, সেদিন আমার আড়াইতলার ছোট্ট এই ঘরটা থেকে তোমাকে – মানে তোমার প্রেতাত্মাকে – আমার বিদায় জানাতেই হলো। আবার, আরেকবার, আমার ঘরে উপদ্রব শুরু করলো নচ্ছার সেই ইঁদুর।

কিন্তু এইবার আমি ছিলাম সাবধান। জহিরের কাছ থেকে টাকা ধার করে নিজের ঘরের জন্য কিনে আনলাম বিশাল এক আয়না, যেন নিজের ছবি ছাড়া আর কিছুই আমাকে দেখতে না হয় – আয়নায় শুধু আমি নিজেকে দেখবো, নিখুঁত এক নার্সিসিস্টের মতো নিজেকেই শুধু নিজে ভালোবাসবো, স্বার্থপরতার কারণে এমনকি ভুলে যাবো মেঝেময় দৌড়াদৌড়ি করতে থাকা ভীষণ একাকী সেই ইঁদুরটার কথাও।

কিন্তু এই কৌশলও বেশিদিন কাজ করলো না – এক মেঘলা সন্ধ্যায় অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, আয়নার ওপাশের মানুষটা আসলে আমি নই। প্রথম কয়েকদিন আয়নায় দেখলাম আমার মৃত বাবার ছবি, কয়েকদিন মা-কেও যেন দেখলাম, এমনকি একদিন নিজের প্রতিচ্ছবির জায়গায় দেখতে পেলাম কবি নির্মলেন্দু গুনকে। আতংকিত হয়ে আয়না সরিয়ে ফেললাম ঘর থেকে। বুঝতে পারলাম না, আয়নায় কেন আমি নিজের ছবি দেখতে পাচ্ছি না। সন্দেহ? হতে পারে।

সেই থেকে ঘরে থাকা একেবারেই কমিয়ে দিলাম আমি, পালিয়ে বেড়াতে শুরু করলাম নাখালপাড়া থেকে। সারাদিন ঘোরা-ফেরা করি প্রাচীন ঢাকা শহরের পথে-প্রান্তরে, সারারাত ধোঁয়া-ওঠা ওষুধের নেশায় ডুবে থাকি চোখ গর্তে ডুবে যাওয়া সায়রা মেয়েটার সাথে। ঘরের ইঁদুরটাকে একেবারেই পাত্তা দিই না, দিনের পর দিন হতাশ করতে থাকি তাকে। ততদিনে আমি বুঝে ফেলেছি, ইঁদুরকে শায়েস্তা করার সত্যিকার উপায় হচ্ছে তাকে পুরোপুরি উপেক্ষা করা। 

কিন্তু ইঁদুরের দৌড়াদৌড়িতে নিজেকে অভ্যস্ত করতে পারলেও সহ্য করতে পারছিলাম না উদ্দেশ্যহীন জীবন কাটানো। সেরকম এক ভোর রাতে ভাবছিলাম, মরে গেলে কেমন হয়? হয়তো সমস্ত সমস্যার সমাধান আছে সমাপ্তিতে। হয়তো আমাদের অস্তিত্বটাই একটা নিছক দুর্ঘটনা।

এসব যখন ভাবছি, আমার আড়াইতলার সস্তা ফ্ল্যাটে বসে, হঠাৎ মনে হলো আয়নার ভেতর থেকে গুরু-গম্ভীর একটা কণ্ঠ ভেসে আসছে। সেই কণ্ঠ আবার কথা বলছে অতি প্রাচীন কোন জনগোষ্ঠীর ভাষায়। এগিয়ে গেলাম আয়নার দিকে, দেখি তীব্র ভীষণ আলো আসছে সেখান থেকে। ছিটকে পিছিয়ে এলাম ওটার কাছ থেকে। ভয় পাই নি, কিন্তু মনে হয়েছে ওই আলোকে দেখার মতো শক্তি আমার চোখের নেই। মনে হয়েছে ওই আলোর দিকে তাকালে আমি অন্ধ হয়ে যাবো, যেটা ওই মুহূর্তে আমি হতে চাই নি। 

দ্বিধা? সন্দেহ? মনে হলো না। বরং মনে হলো, এমন পরিষ্কার দৃশ্য জীবনে কোনোদিন দেখিনি আমি – যা আজ দেখলাম নাখালপাড়ার এক আড়াই তলায় আমার ব্যক্তিগত ঘরে।

সেই ভোররাতে ভেবে ভেবে অস্থির হয়ে গেলাম, কে হতে পারে আমার দৃষ্টিশক্তির বাইরের সেই স্বত্বা। সেই শেষরাতে আমার চিন্তার ওই অস্থিরতা আমাকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখলো, ফজরের আজান কানে যাবার আগ পর্যন্ত। সে রাতে কেমন করে যেন রাত ভোর হওয়ার আগেই নিশ্চিত হয়ে গেলাম, এই পৃথিবীতে আমি একা নই – এমনকি আমার শূন্য ঘরের ভেতরও আমি নিঃসঙ্গ নই।

সেই দিনের পর থেকে – সেই ভোর রাতে আয়নার ওপাশে তীব্র বিশুদ্ধ আলোর একটা ছায়া দেখার পর থেকে – কোন এক অজানা কারণে, আজ পর্যন্ত ইঁদুরটাকে আর মনের ঘরে দেখিনি। যেমন শূন্য থেকে হঠাৎ উদয় হয়েছিল, ঠিক তেমনি আবার রহস্যজনকভাবে শূন্যে উধাও হয়ে গিয়েছিলো সেটা চিরতরে আমার জীবন থেকে।

রক্তিম লাল মলাটের ডাইরিটা শব্দ করে বন্ধ করে ডেডবডিটার দিকে তাকালো নাজমুল হোসেন। এই ছেলেটা ওদের বিল্ডিঙের চিলেকোঠায় থাকতো। অন্য বাড়িওয়ালাদের মতোই হিসেবি  আফসার সাহেব, ছাদে রুম বানিয়ে ব্যাচেলর ভাড়া দিয়েছেন। এখন সে বেওয়ারিশ লাশ। বুঝুক মজা।

আফসার সাহেবের স্ত্রী করিৎকর্মা। নাজমুলকে দেখে বললেন – “বুঝলেন, ছেলেটা একটু অদ্ভুত ছিল।”

তার অবশ্য জানার কথা, তিনিই তো মাসের প্রথম দিন সব ফ্ল্যাটে গিয়ে গিয়ে ভাড়া আদায় করেন।

“একটু না, বেশিরকম অদ্ভুতই ছিল। একা একা থাকতো, কারো সাথে মিশতো না, গেটে কারো সাথে দেখা হলেও কথা বলতো না। সন্ধ্যায় অফিস থেকে যে ফিরতো, এরপর কোথাও বেরুতে দেখতাম না। দিন-রাত ঘরে বসে থেকে কি করতো খোদাই জানে।”

নাজমুলও দেখেছেন দু-একবার ছেলেটাকে। পাশে হেটে যাওয়ার সময় দৃষ্টি ফ্লোরের দিকে রাখতো সে, নাজমুল বুঝতেন এটা ছিল দৃষ্টি এড়ানোর জন্য তার পুরোনো বহু ব্যবহৃত কৌশল। ছেলেটা আসলে তার ঘরের ভেতরই লুকিয়ে থাকত, একরকম পালিয়ে থাকতো নিজের মধ্যে।

“গতকাল রাত্রে মারা গেছে। মনে হয়, হার্ট এটাক। এছাড়া আর কি হবে ! দেখেন, কিরকম ভাগ্য ! এইরকম একটা বয়সে কিনা একা একা মারা গেলো ! আমার কেন যেন মনে হয়, ঘুমের মধ্যে মরেছে। ঘুমিয়েছে, আর উঠতে পারে নি।”

ভদ্রমহিলা বললেন, ভাগ্যিস ওর দূর সম্পর্কের কোন ভাইয়ের নাম্বার ছিল উনার কাছে। তাকেই খবরটা দিয়েছেন আজ সকালে। সেই ভাই আসছে লাশের ব্যবস্থা করতে।

নাজমুলের অফিসের তাড়া ছিল। তাই কথা না বাড়িয়ে দ্রুত লিফটের দিকে পা বাড়ালেন তিনি। তখন তার মনে পড়লো, আফসার সাহেবের স্ত্রীকে ছেলেটার নাম জিজ্ঞেস করা হয় নি। আর কোনোদিনই হয়তো ওর নাম জানা হবে না তার। আফসোস !  

লিফটের দরজা বন্ধ হতেই মনের অজান্তেই দুই আর তিন নাম্বার সুইচ টিপে দিলেন তিনি একসাথে। বুকটা ধ্বক করে উঠলো তার, যখন দেখতে পেলেন দু’টা লাইট একসাথে জ্বলে উঠেছে।

পুরোনো লিফটের ভেতর একা দাঁড়িয়ে থেকে নাজমুল দর দর করে ঘামতে শুরু করলেন। লিফ্ট ততক্ষনে ঢিমে তালে নিচে নামতে শুরু করেছে।

One thought on “আড়াই তলার ভাড়াটিয়া

Leave a reply to trevaughnnally Cancel reply